সারা বিশ্বে মানুষ পানির পরেই সবচেয়ে যে পানীয় বেশি পান করে, তা হলো চা। এর যথেষ্ট কারণও আছে। প্রশান্তিদায়ক প্রভাব, দারুণ স্বাদ এবং স্বাস্থ্যকর গুণের জন্য এই পুষ্টিকর পানীয়র প্রশংসা করা হয়। গবেষকেরা বলছেন, নিয়মিত চা পানের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়, যা দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির সহায়ক।
এ বিষয়ে ডায়েটিশিয়ান এবং ইলিনয়সের একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকসের মুখপাত্র হুইটনি লিনসেনমায়ার বলেন, ‘চা ক্যালোরিহীন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর।’ এই গুণগুলো স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, কোলেস্টেরল লেভেল উন্নত করতে এবং ইমিউন ফাংশন তথা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ২০২২ সালের এক গবেষণা অনুসারে, নিয়মিত চা পানকারীদের মৃত্যুঝুঁকি ১০ বছরে ৯-১৩ শতাংশ কমে যায়।
চায়ে থাকা ক্যাফেইন এবং এল-থিয়ানিন একসঙ্গে মস্তিষ্ককে সতেজ করে, কিন্তু এতে কফির মতো অস্থিরতার অনুভূতি সৃষ্টি হয় না বলে জানান নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান জেনি নরটন। কফির তুলনায় চা থেকে পাওয়া ক্যাফেইন রক্তে ধীরে ধীরে শোষিত হয়, ফলে এটি দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি প্রদান করে।
এদিকে, চায়ে বিপুল পরিমাণে প্রোটিনহীন অ্যামিনো অ্যাসিড এল-থিয়ানিন থাকে। বিষয়টি মানুষের স্নায়বিক শিথিলতা সৃষ্টি করে এবং মানসিক ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এল-থিয়ানিন মনোযোগ বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তি উন্নত করা, স্ট্রেস কমাতে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি গবেষক কুয়ান ভুয়ং বলেন, ‘এটি আপনাকে একটু উমামি স্বাদও (টক-ঝাল-মিষ্টির বাইরে আলাদা একধরনের স্বাদের নাম) দেয়, যা পরিশেষে খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।’
ম্যাচা চা (একধরনের সবুজ চা) এল-থিয়ানিনে ভরপুর। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘরোয়া মসলার মিশ্রণে তৈরি হারবাল চা ক্যাফেইনমুক্ত এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ পান করা যেতে পারে। এমন একটি চায়ের উদাহরণ হতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার রুইবোস। এই হারবাল চা অ্যাসপালাথিন নামে একটি ফ্ল্যাভোনয়েডে ভরপুর, যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। এল-থিয়ানিন ছাড়াও চা সামান্য পরিমাণে গামা-অ্যামিনোবিউটিরিক অ্যাসিড নামক নিউরোট্রান্সমিটার ধারণ করে; যা স্নায়ুকে শিথিল করে এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।
এ ছাড়া চায়ের তাপমাত্রা এবং সুগন্ধি আরও এক ধরনের মানসিক স্থিরতা ও শিথিলতার সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, চা পান করার সময় যে সেন্সরি অভিজ্ঞতা তৈরি হয়, তা কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমাতে, উদ্বেগ কমাতে এবং মানসিক সতেজতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ব্ল্যাক টির সুগন্ধি শ্বাস নেওয়ার ফলে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক চাপের মাত্রা কমে গিয়েছিল। ফুলের চা, যেমন ক্যামোমাইল বিশেষভাবে এই শিথিলতার জন্য বেশি কার্যকর। পিপারমেন্ট চায়ের সতেজ গন্ধ মানসিক সতেজতা বাড়ানোর অন্যতম উপায়।
চা শরীরকে সতেজ (হাইড্রেটেড) রাখার অন্যতম সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা দেয় বলে জানান অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি গবেষক এমা বেকেট। তাঁর মতে, শরীরকে হাইড্রেটেড রাখার ফলে হৃৎপিণ্ড ও পেশি আরও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে, শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের সংযোগস্থলগুলোতে পিচ্ছিল পদার্থ বা লুব্রিকেশন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, হজমে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম বাড়ায়।
যদিও চা একটি ডাইইউরেটিক (প্রস্রাব বাড়ানো) উপাদান, তবে ক্যাফেইনের কারণে এর প্রভাব খুবই সামান্য। ফলে এটি মোটেও নেতিবাচক হয় না। এই বিষয়ে বেকেট বলেন, ‘হাইড্রেশন মানে যে কেবল শরীরে তরল পদার্থ বা পানি থাকা, বিষয়টি সে রকম নয়। হাইড্রেশন হলো শরীরের মধ্যে পানির চলাচল এবং এর মাধ্যমে শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দেওয়া হয় এবং লবণের ভারসাম্য বজায় রাখা হয়।’
চা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের একটি সমৃদ্ধ উৎস; বিশেষ করে, এতে ফ্ল্যাভোনয়েডস উপাদান যেমন ক্যাটেচিন উপস্থিত থাকে। এই উপাদানগুলো মানুষের শরীরের কোষের ক্ষতি প্রতিরোধ করে, প্রদাহ কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ; যেমন হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সবুজ চায়ে ক্যাটেচিনের উচ্চ মাত্রা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিষয়টি প্রদাহ ও ক্যানসার প্রতিরোধে শক্তিশালী উপকারী অবদান রাখে।
গ্রিন টি বা সবুজ চা উচ্চ ক্যাটেচিন স্তরের কারণে বিশেষভাবে প্রশংসিত। এই ক্যাটেচিন প্রদাহ কমানো ও ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর। সবুজ চায়ের প্রধান চারটি ক্যাটেচিন হলো—এপিক্যাটেচিন, এপিগ্যালোকাটেচিন, এপিক্যাটেচিন গ্যালেট এবং এপিগ্যালোকাটেচিন গ্যালেট (ইজিজিসি)। এই চারটি উপাদানই একসঙ্গে এই উপকারিতা দেয়। বিশেষ করে, ইজিজিসি রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ, পেটের চর্বি কমানো এবং ব্যায়ামের সময় চর্বি গলানোর প্রক্রিয়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে বলে জানা গেছে।
যদিও সবুজ চায়ে ক্যাটেচিনের মাত্রা সর্বোচ্চ হলে ব্ল্যাক টি বা কালো চাও কম নয়। ব্ল্যাক টিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের গুণাবলি অক্ষুণ্ন থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গাট মাইক্রোবায়োম তথা পাকস্থলীর অণুজীবের স্বাস্থ্যের সহায়তা করতে ভূমিকা রাখতে পারে, যা হজম থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা পর্যন্ত নানা বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
একাডেমি অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকসের আরেক মুখপাত্র জুলি স্টেফানস্কি বলেন, ‘মানুষ চায়ের ভিন্ন ভিন্ন যৌগ আলাদাভাবে কৃত্রিম উপায়ে আহরণ করার বা পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেছে। তবে চায়ের নির্দিষ্ট যৌগ আলাদা গ্রহণ করার চেয়ে পুরো চা পান করা আরও উপকারী। কারণ, চায়ের ভিন্ন ভিন্ন যৌগ একে অপরের সঙ্গে জটিলভাবে কাজ করে। এগুলো একসঙ্গে কাজ করে।’
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক