জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
.... ...
হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে,
দেখেছি লিখিত—‘রক্ত খরচ’ তাতে।
আমার যখন জন্ম হয়, সেই বছরই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেছেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ক্ষুব্ধ স্বদেশ তখন আন্দোলনে ফেটে পড়েছিল। তৃণমূল থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। একটাই স্লোগান ছিল—রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। যার মীমাংসা হলো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, রক্ত খরচ হলো তাতে। এরপর তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাঁর হাতে ছিল, তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্সহ অনেক শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
পূর্ব বাংলা তার স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিল। জাতীয় পরিষদে এবং প্রাদেশিক পরিষদে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জোয়ার শুরু হয়েছিল। সেই জোয়ারের বিরুদ্ধে আবার ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা একের পর এক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়ে শেষে রাষ্ট্রের শাসন সেনাশাসক আইয়ুব খানের হাতে তুলে দেন। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। মিলিটারির বুটের তলায় হারিয়ে যায় ন্যায্য আন্দোলন। এরপর আবার বাষট্টিতে ছাত্রদের আন্দোলনে রাজপথ মুখরিত হয়, সেখানেও ওয়াজি উল্লাহর রক্ত খরচ হয়। একের পর এক ছাত্র এবং আন্দোলনের পটভূমিতে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। স্বাধিকারকামী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে আগরতলা মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকেই।
আন্দোলন দুর্বার হলে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অবসান হয় বটে। সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। তাঁরা নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হন। ষাটের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে আমাদের অনেক স্বস্তি ছিল, জাতি ছিল ঐক্যবদ্ধ, ছিল সুদূরের স্বপ্ন। নির্বাচনে জয়ী হয়েও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি অনেক রাজনৈতিক নেতার আপত্তির কারণে আমরা ক্ষমতায় যেতে পারিনি। একটা সশস্ত্র যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এবারেও রক্ত খরচ হলো বটে, সেটা এক সাগরের রক্তের মতো।
দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু স্বস্তি মিলল না। রক্তক্ষরণ হতেই থাকে। পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টের রক্তক্ষয় আরও বেদনাদায়ক। আবার সামরিক শাসন। এই শাসনটা বেশ সুদীর্ঘই হলো। আমরা পথে নামলাম। স্বৈরাচারের অবসান হলো। গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এল। দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও অনিশ্চয়তা গেল না, জনগণ স্বস্তি পেল না। মাঝখানে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে, নির্বাচন হয়। কিছুদিন যাওয়ার পরেই সবাই ক্ষমতা দখলের প্রাণপণ চেষ্টায় কাজ করতে থাকে।
এর মধ্যে লুটেরা প্রকৃতির লোকেরা দেশটাকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে বিদেশে তাঁদের অর্থ পাচার করেন। মানুষ শুধু দরিদ্রই থাকে না, অস্বস্তিতে পড়ে চরম। বিত্তহীন এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দারিদ্র্য। রাজনীতিবিদেরা জনগণকে সুস্থির হতে দেন না। দায়িত্বহীন রাজনীতির ফলাফলে আবার গণ-অভ্যুত্থান হয়। তবু স্বস্তি কোথায়? প্রতিদিন খাবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখতে পাই অসহিষ্ণু মানুষ তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে পথে নামছে। দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ায় মানুষ ধৈর্যহীন হয়ে তাদের সব দাবিদাওয়া নিয়ে পথে নেমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজপথে, ছাত্রদের মিছিল, ট্রেনের ওপর আক্রমণ, শিশুদের আর্তনাদ—সেখানেও রক্তক্ষয়।
সাম্প্রতিক আন্দোলনেও ব্যাপক রক্ত খরচ হয়। কিন্তু কিসের আশায়? আশা একটাই—একটা গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ, যেখানে সবাই তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে। আবার কারও অধিকার ফিরে পাওয়ার অর্থ এই নয় যে অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া। সব আন্দোলনের ক্ষেত্র হলো রাজপথ। রেলপথ এবং মানুষের চলাচলে বিঘ্ন করে, জনগণকে জিম্মি করে এ কেমন আন্দোলন? দ্বিধাবিভক্ত তাবলিগ জামাতের যে সমস্যা, সেটা কি কোনো ধর্মীয় সমস্যা? এই সমস্যার কি কোনো রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তো একটি শিক্ষাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত। এটিও কি ‘চাহিবা মাত্র’ সমাধান সম্ভব? পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি সবারই সমর্থন আছে। কিন্তু জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে কি কোনো ন্যায়সংগত দাবি আদায়ের পথে যাওয়াও যুক্তিসংগত?
এখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা বড় দায়িত্ব আছে। আজকাল হরতাল হয় না। কিন্তু একটা সময় ছিল হরতাল। হরতালে লম্বা সময় কেটে যেত তাতে। মানুষের জীবনযাপনে তখন অনেক সমস্যা অবশ্য দেখা যেত। এসব কারণে সরকার কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবত। দেখা যেত শেষ পর্যন্ত সরকারের পতনই হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন যথাসময়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করে না এবং নিজেরা আলোচনায় বসে না? অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকে, তার জবাবদিহি লুপ্ত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে নির্বাচিত সংসদ অকার্যকর হতে থাকে। সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও মুখ চাওয়াচাওয়ি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একেবারেই চলে না।
এই যে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একদিকে বোঝাপড়া, আরেক দিকে দ্বন্দ্ব এবং আরেক দিকে যৌথভাবে কাজ করা—এই সংস্কৃতিটা আমাদের দেশে গড়েই উঠল না। এই গড়ে না ওঠার কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো সরকার এবং বিরোধী দল সব সময় একটা মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে জুড়ে থাকে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সরকার দিনের পর দিন মামলায় ব্যস্ত থাকে। আইনজীবীদের তাতে সুবিধাই হয় এবং রাজনৈতিক বিতর্ক পবিত্র আদালতের এজলাসকেও রাজনীতির ক্ষেত্র বানিয়ে দেয়। নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হচ্ছে আদালত। কিন্তু এখন যেহেতু আইনজীবীরা বিভক্ত, তাই ওই জায়গাটিও আর নাগরিকদের জন্য নিরাপদ নেই। শুধু তা-ই নয়, বিচারকদের সম্পর্কেও নানান ধরনের সংশয় দেখা দেয়। এবং বিচারব্যবস্থার মধ্যেও কখনো দুর্নীতি ঢুকে যায়। বিচারব্যবস্থায় যদি দুর্নীতি ঢুকে যায়, স্বজনপ্রীতি আসে, তাহলে মানুষের আশ্রয়ের আর জায়গা থাকে না। আমরা বারবার আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপতিদের সামনে এমন সব ঘটনা দেখেছি, তাতে ওই পবিত্র স্থানগুলো কখনো কখনো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
আমাদের এতই দুর্ভাগ্য যে এত অর্থ ব্যয়ে যে জাতীয় সংসদ ভবনটি নির্মিত হয়েছে এবং সংসদ সদস্যদের জন্য এতসব সুযোগ-সুবিধা করা হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা কারও একটি পূর্ণ শাসনামলে সংসদ চালু থাকতে দেখিনি। পৃথিবীর যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানেও যাদের অবস্থান অনুকরণীয় তাদের দেশে সংসদে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক, গোলমাল হয়। কিন্তু তারা নির্বাচনের পর নির্বাচন করে সংসদ অটুট রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা তা পারি না। আমরা বারবার দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষমতা গ্রহণ দেখেছি, সেটিও বিপজ্জনক। সেখানে যেকোনো আইন তারা পাস করে নিতে পারে, নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে পারে। এবং এটা করতে তারা একপর্যায়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করে। মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না, দেশের সুশাসন নিশ্চিত হয় না। দীর্ঘদিন শাসক থাকলে দুর্নীতিও বন্ধ করা যায় না। দুর্নীতির নানান ডালপালা বের হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য বুদ্ধি বের হয়। প্রকারান্তরে যা প্রতিশোধ স্পৃহা হয়ে দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রতিশোধ স্পৃহা যদি ঢুকে যায় তা হয় মর্মান্তিক। দলীয় প্রতিশোধ থেকে তা ব্যক্তির প্রতিশোধে রূপ নেয়। এই ব্যক্তির প্রতিশোধ বড়ই মারাত্মক। আমরা কি একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ সমাজ গড়তে চেয়েছি? আমরা পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়েও বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়েও স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিশোধ স্পৃহা সেখানে পাওয়া যায়নি।
দেশটা বড়। কিন্তু ছোট ছোট সংকীর্ণতা নিয়ে আমরা যদি নিজেদের গড়ে তুলি, তাহলে কি দেশটা বড় হবে? তাই দেশ যেমন বড় হতে পারে না, তেমনি মানুষও সংকীর্ণ হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করা উচিত রাজনীতিবিদদের। কোনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করলেই আমরা হয়ে পড়ি তার প্রতিপক্ষ দলের লোক। আবার বিরোধী দলের পক্ষে কোনো সমালোচনা করলে আমরা হয়ে পড়ি সরকারের লোক। একটি অদ্ভুত শব্দের তকমা আমাদের কপালে জুটতে থাকে। সমাজকে যুক্তিনির্ভর করতে হলে সর্বাগ্রে রাজনীতিকদের উদারতা খুব প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এই বিষয়টি বারবার ব্যাখ্যা করা দরকার। কিন্তু দেখা যায়, ক্ষমতাসীনেরা শিক্ষার সিলেবাসটাই কখনো কখনো পাল্টে দেন তাঁদের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য। তাই যুক্তি-তর্ক বাদ দিয়ে দাবি আদায় করতে সম্মিলিত পেশিশক্তির প্রভাবই দেখতে পাওয়া যায়।
আজকে সংস্কারের আয়োজন চলছে, তা কয়েকটি কমিশন করে সংস্কার কতটুকু সম্ভব, এটা একটা প্রশ্ন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঠিক না করলে কোনো কমিশন যতই সুচিন্তিত হোক না কেন, সেটা কাজে লাগবে না।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব