ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান ২৫ ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর সমন্বয়ক। জনপ্রশাসনে আন্তক্যাডার বৈষম্য ও বিরোধ, প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি বাকি ক্যাডারদের ক্ষোভ এবং তাঁদের অন্যান্য দাবি-দাওয়ার বিষয় নিয়ে তিনি আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলেছেন।
আপনারা কেন আন্দোলন করছেন?
আমরা আসলে আন্দোলন করছি না। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার একটি জনবান্ধব সিভিল সার্ভিসের আমূল সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার যেহেতু সংস্কার করতে চায়, সেহেতু যথাযথ সংস্কার করার জন্য খুঁটিনাটি বা ভেতরের ব্যাপারগুলো জানা দরকার। আমরা যাঁরা বিভিন্ন ক্যাডারে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করছি, আমরা যতটা ভেতরের বিষয়গুলো জানি, যাঁরা সেই পেশার সঙ্গে যুক্ত না, তাঁরা সে বিষয়গুলো জানবেন না। এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাঁরা কিছু বিষয় জানতে পারেন। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো, সরকারকে আমাদের ক্যাডারের বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে অবহিত করা।
আমরা আসলে সরকারকে এ বিষয়গুলো জানানোর জন্য সংগঠনটি তৈরি করেছি। সেই জায়গা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা কখনো আন্দোলন করিনি এবং এখনো করছি না।
ক্যাডার সমস্যা তো দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি কেন আপনারা আন্দোলনে যুক্ত হলেন?
এটা আসলে সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এসব নিয়ে কথা বলছি। আমরা ২০১২ সালে একবার এবং ২০১৬ সালে আরেকবার আন্দোলনে ছিলাম। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারের সময়েও এসব ইস্যু নিয়ে কথা উঠেছিল। ২০১৬ সালে আমরা একটা আন্দোলন করেছিলাম, সেখানে ১০০ দিনের মধ্যে সব বিষয় সমাধানের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। সে সময়ও কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।
আসলে এটা কোনো নতুন ইস্যু না, এটা পুরোনো ঘটনা। যখনই বিভিন্ন সরকার সমাধান বা সংশোধনের জন্য কমিশন গঠন করেছে, তখন সেটা গঠিত হয়েছে শুধু একটিমাত্র ক্যাডারের লোক দিয়ে। এবারও তা-ই হয়েছে। পূর্বে একটি ক্যাডারের লোক দিয়ে কমিশন গঠনের কারণে বৈষম্য দূর করার চেয়ে বৈষম্য আরও বেড়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে একটা নির্দলীয় বা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, এ সরকার সিভিল সার্ভিসের সমস্যাগুলো সমাধান করবে। সে জন্য আমরা এই সমস্যাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বর্তমান কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেন আপনারা?
এখানে দুটি বিষয়। একটি হলো, আমাদের বিধান ছিল উপসচিব পুলে মেধার ভিত্তিতে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হবে। সব ক্যাডারের সেখানে সমান সুযোগ থাকবে। ১৯৭৫ সালের ‘সার্ভিস অ্যাক্ট’ এবং ১৯৭৯ সালের ‘সিনিয়র সার্ভিস পোল’ (এসএসপি) অর্ডার-এর মাধ্যমে এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বন্দোবস্ত। কিন্তু সেটাকে পরবর্তী সময়ে কোটায় নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথমে ছিল সংখ্যাভিত্তিক কোটা। এটা করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। পরে ১৯৯২ সালে সেই কোটা বাতিল করা হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে আবার ৭৫ শতাংশ কোটা আরোপ করা হয়।
দ্বিতীয় হলো, ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যে আন্দোলন করল, তারা যখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে প্রবেশ করবে, তখন তারা দেখতে পাবে চাকরির মধ্যে আবার ৭৫ শতাংশ কোটা। তারা তখন আবার আন্দোলন করবে। আমরা চাই না, আমাদের ছেলেমেয়েরা আরেকবার জীবন দিক। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরুক, আমরা সেটা চাই না। সে জন্য আমরা তাদের অগ্রজ হিসেবে দায়িত্ব মনে করছি আর যেন ভবিষ্যতে আমাদের নতুন প্রজন্মকে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। কোটামুক্ত ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হোক, সেটার জন্যই আমরা কোটার বিরুদ্ধে কথা বলছি।
আপনাদের অন্যতম দাবি, ‘ক্যাডার যাঁর, মন্ত্রণালয় হবে তাঁর’। এ দাবির যৌক্তিকতা কী?
এ দাবির যৌক্তিকতা হলো যে আপনি নিজেও একজন সাংবাদিক। আপনি আপনার পেশায় যত দক্ষ হবেন, আমি যতই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি না কেন, আপনার পেশায় আমি অত দক্ষতা দেখাতে পারব না। যার কাজটা তাকে যদি করতে দেওয়া হয় এবং তার কাজের জন্য তাকেই জবাবদিহি করা যায়, তাহলে এ দেশটা জনবান্ধব হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এখন একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারের লোক আজকে এই মন্ত্রণালয় আবার কালকে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা কিন্তু কোনো মন্ত্রণালয়কেই ধারণ করতে পারছেন না। কারণ, ধারণ করতে হলে তাঁকে তো সেই মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে জানতে হবে। আমরা একটা পেশার মধ্যে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে সেই পেশার সাদা-কালো সব বিষয় জানার সুযোগ থাকে। কিন্তু অন্য পেশার লোক এই পেশায় ছয় মাস বা এক বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করলে, সমস্যা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমরা সবাই জানি, যেকোনো অর্থবছরের বাজেটের কাজ শেষ দুই-তিন মাসে শেষ করার জন্য হুলুস্থুল কাণ্ড পড়ে যায়। কারণ, এক বছরের বাজেটের কাজ ৯ মাসেও শেষ করা সম্ভব হয় না। কেন এ রকম হয়? কারণ হলো—তলিয়ে দেখুন, খতিয়ে দেখুন—এভাবে আমাদের দেশটা চলছে। এ ধরনের ঘটনার মূল ব্যাপার হলো, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তো এ সেক্টরের কাজে অভিজ্ঞ না। তাই আমরা বলছি, যে পেশার লোক তাকে সেই পেশায় দায়িত্ব দিলে সেটা জনবান্ধব ও সেবাবান্ধব হবে। সে জন্য আমরা বলছি, ক্যাডার যাঁর, মন্ত্রণালয় হবে তাঁর।
এখানে জনপ্রশাসনই একটা বড় ফ্যাক্টর। এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে ঔপনিবেশিক কাঠামো বহাল থাকার কারণে। আপনারা কিন্তু আসল জায়গায় ধরে কথা বলছেন না। কারণ কী?
আসলে ‘জনপ্রশাসন’ শব্দটাই একটা বিতর্কিত শব্দ। সার্ভেন্ট কখনো প্রশাসক হতে পারে না। আর একটা বিষয় হলো, এটার নাম ছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। তারা কী কায়দা-কৌশল করে সরকারকে ম্যানেজ করে তাদের প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে মিলিয়ে জনপ্রশাসন নাম করেছে। আমরা বলতে চাই, এখন যদি ডিএস পুল ওপেন হয়ে যায় তাহলে সব ক্যাডারের লোক এই মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তাতে একটা ব্যালেন্স অব পাওয়ার তৈরি হবে। এখন কিন্তু সেটা নেই। তারা যা খুশি তাই করছে। দেখুন, এখন তারা আমাদের ঢালাওভাবে বরখাস্ত করছে। এটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করছে। কারণ, এই মন্ত্রণালয় তো তারাই চালায়। এবং তাদের ক্যাডারের লোকজন প্রচুর অশালীন শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাঁদের জন্য কিন্তু তারা বরখাস্তের ব্যবস্থা করেনি। এভাবে তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সব ক্যাডারের লোক থাকার সুযোগ পেলে একটা ব্যালেন্স তৈরি হবে এবং রাষ্ট্রটিও জনবান্ধব হবে।
অন্য ক্যাডারদের ওপর প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাবটা কেমন? এতে আপনাদের কী ধরনের সমস্যা হয়?
আমরা তাঁদের কারণে কোনো কাজই করতে পারি না। কোনো ক্যাডারই তাঁর যে চিন্তা-চেতনা, তাঁর ক্যাডারের সমস্যা এবং জনগণকে সেবা দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। সব মন্ত্রণালয়ই একটা ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি যদি আমার সেক্টরে কিছু করতে চাই, সিদ্ধান্ত তো আসবে ওই ক্যাডারের লোকদের পক্ষ থেকে। সে কারণে আমি আমার মতো কাজ করতে পারছি না। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও কোনো ক্যাডারের লোকই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। কোনো সেক্টরও পারেনি।
আপনারা পত্রিকার পক্ষ থেকে যদি একটা জরিপ করেন, দেখবেন এ দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় সেবার জন্য অসন্তুষ্ট। কেন তারা অসন্তুষ্ট? আমরা তো তাদের সেবা দিতে পারছি না।
সে জন্য আমরা বলছি, এই অবকাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। একদিকে আমাদের ক্ষোভ, বিক্ষুব্ধতা আছে, অন্যদিকে আমরা জনগণকে সেবা দিতে পারছি না। এই যে প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া দৌরাত্ম্য, সেটা অন্যান্য ক্যাডারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এতে দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। একদিকে আমরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছি না, অন্যদিকে জনগণকে আমাদের ফেস করতে হয়, জবাবদিহি করতে হয়।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ৫০-৫০ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দেওয়ার পক্ষে। আপনারা এ প্রস্তাবের কেন বিরোধিতা করছেন?
সমস্যাটা সেখান থেকে হয়নি। আমরা ৬ আগস্ট থেকে কাজ শুরু করেছিলাম। ৩০ আগস্ট আমাদের একটা সংগঠন গঠিত হয়। আমরা ৩১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সেটা জানাই। তার পর থেকে আমরা ১১ জন উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা বলেছি, এই এইভাবে এ রাষ্ট্রকে সুন্দর করা যায়। এভাবে করলে রাষ্ট্র জনবান্ধব হবে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এটাই আসলে পক্ষপাতমূলক। কারণ, প্রথম যখন আট সদস্যের কমিশন গঠিত হয়, তার মধ্যে ছয়জনই হলেন প্রশাসন ক্যাডারের। সেখানে বাকি ২৫ ক্যাডারের কেউ ছিলেন না। তখনই আমরা সরকারকে বলেছিলাম, তাঁরা তো কাজ করতে পারবেন না।
পরবর্তী সময়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন একটা রিপোর্ট করে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরল ৫০-৫০ কোটার কথা। তখন সব ক্যাডারের লোকজনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।
আমরা তার আগে গোলটেবিল বৈঠক করেছি, উপদেষ্টা ও সুধী মহলের সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সরকারকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।
তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। আমরা বিশ্বাস করি, অন্তর্বর্তী সরকারই এই ধরনের সংস্কার করতে পারবে। সে জন্যই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ৫০-৫০ শতাংশ কোটা দিয়ে রুটি-হালুয়া ভাগাভাগির মতো প্রস্তাব দিল। তাহলে এত বড় গণ-অভ্যুত্থান তো কোটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হয়েছে। কেন তাহলে আবার কোটা? তাঁরা কেন সেটা ওপেন করে দেবেন না? জনপ্রশাসনের সব লোক তো মেধাবী বলে দাবি করেন। তাহলে তাঁরা পরীক্ষা দিতে ভয় পান কেন?
আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসনে আপনারা আন্দোলন করছেন। আন্দোলন এখন কোন পর্যায়ে?
আমি আবারও বলছি, এটা আন্দোলন নয়। আমরা চেষ্টা করছি সরকারের পাশে থেকে তাদের সহযোগিতা করতে। আশা করছি, আমরা ভালো কিছু করব। সে জন্য আমরা আমাদের সহকর্মীদের বলছি, আমরা সংস্কার কমিশনের ফাইনাল রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আমরা চাই, এই সরকার একটা জনবান্ধব জনপ্রশাসন দেশবাসীকে উপহার দেবে। তাহলে আমরা সরকারের সঙ্গে থাকব।