জাতি হিসেবে আমরা তিনটি বড় গণ-অভ্যুত্থানের সাক্ষী। ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং সর্বশেষ ২০২৪-এ। তিনটি গণ-অভ্যুত্থানেরই উদগাতা ছাত্রসমাজ। পরে এগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তি ঘটে এবং তা সফল পরিণতি লাভ করে। আজ ২৪ জানুয়ারি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ৫৬তম বার্ষিকী।
১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন উনসত্তরে এসে ব্যাপকতা লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল মো. আইয়ুব খানের একনায়কতন্ত্র ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের সীমাহীন অবিচার বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারেনি। তারা গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও সম-অধিকারসহ ছাত্রসমাজের অন্যান্য দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রণয়ন করেছিল ১১ দফা; যার প্রতি গোটা পূর্ব পাকিস্তানবাসী সমর্থন জানিয়েছিল।
পাশাপাশি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ছয় দফা পেশ করেছিল। অন্যদিকে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্রের দাবিতে দিয়েছিলেন ১৪ দফা। ১৯৬৬-এর হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে সফল ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূলত আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। উনসত্তরে এসে সব দাবি এক মোহনায় মিলিত হয়ে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়।
ওই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন অভিযুক্ত বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার বিচার চলছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ আদালতে। মূলত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এ মামলাটি আইয়ুব সরকার করতে চেয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও তাঁর ৩৩ জন সহযোগীর বিরুদ্ধে। শেখ মুজিবুর রহমান ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত না থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানি কতিপয় আমলা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন জেনারেলের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাঁকে এক নম্বর আসামি করার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বিনষ্টের চক্রান্তের অভিযোগ এনে শেখ মুজিব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি এবং একই সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তির (ফাঁসি) মাধ্যমে তাঁকে শেষ করে দেওয়া। কিন্তু সে চক্রান্ত শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাই শেখ মুজিবকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয়তার পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছে দেয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরুর আগে থেকেই শেখ মুজিব কারাগারে ছিলেন। তাঁকে ওই মামলার প্রধান আসামি করে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ঘোষণা দেওয়া হয় বিচারের। সেই দুঃসময়ে তাঁর পাশে কেউ ছিল না। এ সময় তরুণ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (পরে মন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি ও বিএনপির নেতা), ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও কে জেড ইসলাম কিছু একটা করার চিন্তা করেন। এ সম্পর্কে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর ‘বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা ভাবলাম প্রথমে মিসেস মুজিবের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় আমরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তার বাসায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। অনুজ্জ্বল আলোয় তাঁর বাড়িটি খুব নির্জন বলে মনে হচ্ছিল এবং তাঁকে লাগছিল নিঃসঙ্গ। যখন আমরা প্রস্তাব করলাম যে মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য আমরা একজন ব্রিটিশ আইনজীবী নিয়োগ করতে চাই, মিসেস মুজিব তা বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমাদের আন্তরিকতা দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘এমনকি একটা কাকপক্ষীও এখন আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যায় না। বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনেরা এ বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি আপনাদের কাউকে চিনি না। কেন আপনারা এত ঝুঁকি নিচ্ছেন?’ মুজিবের স্ত্রী দৃঢ়নিশ্চিত ছিলেন যে এবার তাঁর স্বামীকে শেষ করে ফেলা হবে এবং সম্ভবত তিনি আর তাঁর দেখা পাবেন না। ১৮ জানুয়ারি আর্মির লোকেরা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুজিবকে তুলে নিয়ে যাবার পর থেকে তিনি কোথায় রয়েছেন, এমনকি তাঁর পারিবারিক সদস্যরাও তা জানতে পারেননি। কাজেই আমাদের প্রস্তাব শোনার মতো কোনো প্রত্যাশা তাঁর ছিল না। মুজিব তখন বেঁচে আছেন কি না সেটা জানতেই তিনি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন। বেশ কয়েকবার আমরা বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করি। শেষ পর্যন্ত মানিক মিয়ার (ইত্তেফাক সম্পাদক) হস্তক্ষেপ ও সাহায্যে আমরা তাঁর স্বামীর পক্ষাবলম্বনে মিসেস মুজিবের সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হই। প্রায় চার সপ্তাহ পরে মিসেস মুজিব চূড়ান্তভাবে সম্মতি জানান। একদিন অনেক রাতে আমার বাসায় এসে তিনি আমার কাছে মুজিবের সই করা একটা ওকালতনামা দিয়ে যান। এভাবে একজন ব্রিটিশ আইনজীবী নিয়োগের একক দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়ে।’ (পৃষ্ঠা: ৮৪-৮৫)। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়ামস শেখ মুজিবের পক্ষে আইনি লড়াই করতে ঢাকায় আসেন। এরপর দুই বছর সে আইনি লড়াই চলেছিল।
কিন্তু ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে এসে এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে বিচারের নামে একটি প্রহসন মঞ্চস্থ করে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে বদ্ধপরিকর। শেখ মুজিব নিজেও তা বেশ বুঝতে পারছিলেন। সে সময় আইয়ুবের পরিকল্পনা বানচাল করতে একটি জোরদার গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন সবাই। সেনানিবাসের বিচারকক্ষে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি ছিল। সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফয়েজ আহমদ ও আতাউস সামাদ। একদিন শেখ মুজিবুর রহমান আতাউস সামাদকে চুপিসারে বলে দেন, ‘হুজুরকে (মওলানা ভাসানী) বলবেন সময় হয়ে গেছে’। পুত্রসম শেখ মুজিব স্বৈরাচারী সরকারের হাতে বন্দী এবং তাঁকে শেষ করে ফেলার চক্রান্ত চলছে—এ ভাবনায় মওলানা ছিলেন উদ্বিগ্ন। তিনিও আন্দোলন শুরু করার কথা ভাবছিলেন। আতাউস সামাদের মারফত শেখ মুজিবের বার্তা পেয়ে তিনি বললেন, ‘মজিবর কইছে, সময় হইয়া গেছে? তাহলে আর দেরি করন যায় না।’ (মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ও সাবেক কেন্দ্রীয় প্রবীণ ন্যাপ নেতা শামসুল হকের সঙ্গে নিবন্ধ লেখকের একান্ত আলাপ)। এরপর একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে এক উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন।
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের নিহত হওয়ার ঘটনায়। তাঁর হত্যার প্রতিবাদে ২৪ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ডাকা হয় সর্বাত্মক ধর্মঘট। এদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয় নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। কিশোর মতিউরের শাহাদাতবরণের খবর আন্দোলনের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। গোটা দেশ যেন আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠে। জনবিস্ফোরণের সেই লাভা পুড়িয়ে ছাই করে দেয় আইয়ুব খানের তখতে তাউস। তবে ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হলেও আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন তারও দুই মাস পরে। অবশ্য সেদিনের পরই তাঁর গদি নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিবের মুক্তি ও আইয়ুবের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন ছিল অব্যাহত।
এরই মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি সেনানিবাসে ঘটে এক নৃশংস ঘটনা। আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের জানাজা শেষে লাখো মানুষের জনসভায় মওলানা ভাসানী হুংকার দিয়ে বলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে তিনি শেখ মুজিবকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবেন। পরিস্থিতি তখন আইয়ুব সরকারের আওতার বাইরে। জনরোষের মুখে আগরতলা মামলার বিচারের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এস এ রহমান রাতের অন্ধকারে বাসার পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপরই নানা নাটকীয়তার পর ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবসহ সব বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।
এরপরেও আইয়ুব খান ক্ষমতায় টিকে থাকার বহু চেষ্টা-তদবির করেছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন। তাঁর জায়গায় আসেন আরেক স্বৈরশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। আইয়ুব খানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের; যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। বস্তুত এখানেই নিহিত উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মহিমা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক