Ajker Patrika
হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

এনআইডি নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নতুন বিতর্ক তৈরি করবে

আবু তাহের খান 

এনআইডি নিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান নতুন বিতর্ক তৈরি করবে
প্রতীকী ছবি

গণমাধ্যমের খবর, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি নিবন্ধন এবং ইউনিক আইডিসহ বিভিন্ন নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার একটি স্থায়ী নাগরিক নিবন্ধন কমিশন (সিআরসি) গঠন করতে যাচ্ছে (আজকের পত্রিকা, ৫ মার্চ ২০২৫)। ওই খবর থেকে এটিও জানা যায় যে উপদেষ্টা পরিষদের নির্দেশে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ইতিমধ্যে এই কমিশনের সম্ভাব্য কাঠামো, কার্যক্রম ও আনুষঙ্গিক বিষয়সংবলিত অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেছে, যা নিয়ে ৩ মার্চ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তৎপরতার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, উল্লিখিত কমিশন গঠনের বিষয়টিকে সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়ে খুবই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

এখন কথা হচ্ছে, যেসব কাজ সম্পাদনের কথা বলে কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে কাজগুলো সর্বোচ্চ দক্ষতার সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ও হয়রানিমুক্ত ব্যবস্থার অধীনে সম্পন্ন করার জন্য এরূপ একটি কমিশন গঠনই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত কি না, তা কি যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে? নাকি এনআইডি কার্যক্রম আগের মতো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে থেকে যাবে, নাকি তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হবে মর্মে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, সে বিতর্ককে প্রশমনের জন্যই এটি করা হয়েছে? প্রশ্নগুলো কেন উঠল, সেটি এবং উল্লিখিত কর্মকাণ্ডগুলো সম্পাদনের জন্য সিআরসি গঠন কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা হওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ, নানা অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের আধিক্যের ভারে বাংলাদেশের রাষ্ট্র খাতের এমনিতেই চরম ন্যুব্জ দশা। তার ওপর আগে থেকে চলে আসা একটি পুরোনো কাজের জন্য যদি নতুন করে এনআরসির মতো আরেকটি মাথাভারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয়ই শুধু বাড়বে না, আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যাও বাড়বে এবং সেবাদানের ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হবে।

২০১০-এর দশকের গোড়া থেকে শুরু হওয়া এনআইডিসংক্রান্ত কার্যক্রম গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইসির আওতাতেই চলে আসছিল। ২০২৩ সালে এসে হঠাৎ করেই এ দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাজটি দীর্ঘদিন থেকে ইসির আওতায় চলে আসার সুবাদে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে এনআইডির সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার কারণে ইসি এটি তাদের নিজেদের আওতায়ই রাখতে চায়, যে দাবি তারা ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকেও উত্থাপন করেছে। তদুপরি এ দাবি পুনর্ব্যক্ত করে ৯ মার্চ তারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে পুনরায় একটি চিঠি পাঠিয়েছে। এদিকে ১২ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এনআইডিসহ নাগরিকের ডেটা নিয়ন্ত্রণে ‘জাতীয় ডেটা কর্তৃপক্ষ’ (এনডিএ) গঠিত হবে। তাঁর বক্তব্যে এ কাজে স্থানীয় সরকারের ভূমিকাকে অনেকটা তাচ্ছিল্যও করা হয়েছে। মোটকথা, বিষয়টি এখন এক হযবরল অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এনআইডি কার্ড প্রদানের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় ন্যস্ত করার কারণটি মোটেও বোধগম্য নয়। কেননা, নাগরিকমাত্রই, এমনকি তিনি যদি চিহ্নিত বা দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও হন, এনআইডি কার্ড পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অবস্থায় এনআইডি কার্যক্রম কার আওতায় সম্পন্ন হবে, এ নিয়ে উল্লিখিত দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যেই নতুন করে সিআরসি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে এসবের ভিড়ে এনডিএর অবস্থান কী হবে, সেটিও বোঝা দরকার। তবে এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এনআইডি প্রদানের কাজটি এ-জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান করে না, করে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো, যেটি বাংলাদেশেও হওয়া উচিত। ফলে এ কাজের জন্য নতুন করে সিআরসি বা এনডিএ গঠন না করে কাজটি কীভাবে ক্রমান্বয়ে পুরোপুরিভাবে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করা যায়, তা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত।

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজটিও বিশ্বজুড়ে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবেই স্থানীয় সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়ে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও সে ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখানে এটি চালু হয়েছে মূলত পাসপোর্ট ও এনআইডি প্রদানসংক্রান্ত কাজের শর্তের অংশ হিসেবে, স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হিসেবে নয়। আসলে এটিকে নিয়মিত বাধ্যতামূলক নাগরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে চালু করা প্রয়োজন। অর্থাৎ যেকোনো নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যুর বিষয়টি তার অভিভাবককে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কার্যালয়ে নিবন্ধিত করতে হবে। আর সে নিবন্ধিত তথ্যই সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (নির্বাচন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) তাদের নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করবে। কিন্তু এর জন্য কোনো অবস্থাতেই সিআরসি বা এনডিএর মতো মাথাভারী বাড়তি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই।

এসব করা হলে তা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও স্বনির্ভর করে তোলার চিন্তাভাবনাকে আরও পিছিয়ে দেবে, যার আভাস ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের কথাতেও রয়েছে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিক বা আমলা কেউই নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কায় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী হতে দিতে চান না। এ অবস্থায় রাজধানীকেন্দ্রিক সিআরসি বা এনডিএ গঠন করা হলে এর মাধ্যমে রাজনীতিক ও আমলাদের ওই হীন আকাঙ্ক্ষাই আরও প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাবে। মোটকথা, এসব মাথাভারী প্রতিষ্ঠানের চিন্তা পরিপূর্ণভাবেই সংবিধান নির্দেশিত স্বনির্ভর-শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ধারণার পরিপন্থী এবং এই মুহূর্তে এ ধরনের চিন্তাভাবনা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে।

বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদসংক্রান্ত নিবন্ধন ব্যবস্থাটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি কাজ। জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের মতো এটিও যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সরকারের আওতায় ন্যস্ত করা উচিত। আর এনআরসির আওতায় ইউনিক আইডি প্রদানসংক্রান্ত যে সেবার কথা বলা হচ্ছে, সেটি বস্তুত আইডি কার্ড সেবারই সম্প্রসারিত অংশ। ফলে এটিও খুব স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকা উচিত। তারপরও এ নিয়ে বলতে হচ্ছে এ কারণে যে সিআরসি গঠনের যুক্তি হিসেবে ইউনিক আইডি প্রদানকেও একটি স্বতন্ত্র কাজ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যা ধারণাগতভাবে সঠিক নয়।

এরপরও যদি উল্লিখিত বাস্তবতা এবং তথ্য ও যুক্তিকে উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার সিআরসি বা এনডিএ গঠন করে, তাহলে একেবারে প্রথমেই যা ঘটবে তা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের সমস্যা। কারণ, মাঠপর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে উল্লিখিত তথ্যের জন্য তাদের শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এবং এতে করে সমন্বয়ের সমস্যাই শুধু বাড়বে না, পুরো প্রক্রিয়াটিই এক বিদঘুটে জটিল আকার ধারণ করবে। আর যদি বলা হয় যে তারা সারা দেশে তাদের বিস্তৃততর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, তাহলে তা হবে আরও এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাস্তব চিন্তা। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের আওতায় যেকোনো নতুন কমিশন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মানেই রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, যা ইতিমধ্যে সামন্ত যুগের রাজসিক কাজকারবারকেও ছাড়িয়ে গেছে।

বাজেটের আওতায় বাংলাদেশের ‘রাজ কর্মচারীদের’ পেছনে ব্যয়িত অর্থের হিস্যা এখন প্রায় ৪৩ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই তা আর বাড়াতে চাইবেন না। তা ছাড়া, সরকারের কথিত সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গেও এরূপ প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির ধারণা সংগতিপূর্ণ নয়। সরকারের সংস্কার কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য তো রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা জনসেবাকে জটিলতামুক্ত করা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা এবং রাষ্ট্রের পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আনা। কিন্তু উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ গঠনের মধ্য দিয়ে এগুলোর সব কটিই লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সব মিলিয়ে তাই বিনীত প্রস্তাব, রাষ্ট্রের নাগরিকদের এনআইডি ও ইউনিক আইডি প্রদান এবং তাদের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহবিচ্ছেদ ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য নিবন্ধনসংক্রান্ত সেবার জন্য নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজন নেই। বরং প্রয়োজন হচ্ছে এ কাজগুলোকে ক্রমান্বয়ে স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করার বিষয়ে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর তা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সরকারের দায়িত্ব হবে বিদ্যমান কাঠামোর আওতাতেই এ সেবাগুলোকে কীভাবে সব ধরনের ঝঞ্ঝাট-জটিলতা ও হয়রানিমুক্ত ব্যবস্থার আওতায় প্রদান করা যায়, তা নিশ্চিত করা। আশা করব, প্রধান উপদেষ্টা গঠনমূলক ভিন্নমতকে স্বাগত জানিয়ে প্রায়ই যেসব বক্তব্য দেন, সেসবের সঙ্গে সংগতি রেখে এসব নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ থেকে সরকারকে বিরত রাখবেন। তবে উল্লিখিত সেবাগুলোকে কীভাবে আরও জনবান্ধব করে তোলা যায়, সে ব্যাপারে নিজের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি রাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন।

লেখক: আবু তাহের খান

অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি

ভারতের দুমুখো নীতিই সম্পর্কোন্নয়নের অন্তরায়

নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেন

আমরা কি শুধু মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকব

ধর্ষণ প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

শব্দের আড়ালে গল্প: ফ্যাঁকড়া

দেশের হৃৎপিণ্ডে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে গেল মেয়েটি

তরুণেরাই মোড় পরিবর্তনের দিশারী

আমাদের গণতন্ত্র এবং কাঠমান্ডুর অভিজ্ঞতা

ক্ষমতার বদল নয়, বদল ঘটাতে হবে ব্যবস্থার

স্বপ্ন আছে বলেই আমরা এখনো আছি