‘যে আগুন জ্বলেছিল’ বইটি হঠাৎ হাতে এসেছিল আমার। সে বইয়ে নিমগ্ন হতে সময় লাগেনি। মো. আনিসুর রহমান সম্পর্কে তখন থেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠি। গুণী অর্থনীতিবিদ, বিকল্প উন্নয়ন দার্শনিক, রবীন্দ্র-গবেষক, শিল্পী এই মানুষটি একসময় স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যের। আমরা যখন জিয়নকাঠি নামের আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সে সময় তিনি বিপ্লব বালার সঙ্গে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে, সেখানে তখন দলের মহড়া চলত। জিয়নকাঠির সদস্যদের সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছেন আড্ডায়, তাঁদের শুনিয়েছেন নিজ কণ্ঠে গান। জিয়নকাঠির সদস্যরাও তাঁর রচনা থেকে বাছাই করা অংশ নিয়ে তৈরি করেছিলেন স্ক্রিপ্ট।
গত রোববার তিনি চলে গেলেন। ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস পড়ল তাঁর। বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। এক লেখায় তাঁর জীবনের নানা দিক তুলে ধরা কঠিন। সে চেষ্টাও করব না।
বাঙালিমাত্রেই জানেন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন সারা পূর্ববঙ্গ চষে বেড়াচ্ছেন, তখন পূর্ব বাংলার জনগণ ৬ দফার মধ্যেই খুঁজে পেল নিজেদের মুক্তির ঠিকানা। সে বছরের মে মাসের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। কিন্তু আন্দোলন কখনো ঢিমে তালে, কখনো প্রবল গতিতে চলতে লাগল। আন্দোলনের তোড়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেওয়া হলো ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি।
ইতিহাসের এই অংশটি মনে রেখে এবার আমরা চোখ ফেরাব মো. আনিসুর রহমানের দিকে। ১৯৬৯ সালের দিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা প্রবলভাবে বলা শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ডাকলেন অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলামকে। তিনি তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধু তখন নূরুল ইসলামকে বোঝালেন, ৬ দফার প্রতিটি দফাকে জোরালো ও বিস্তারিতভাবে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এই প্রয়াসে যে একদল বাঙালি অর্থনীতিবিদ যোগ দিয়েছিলেন, মো. আনিসুর রহমান তাঁদেরই একজন।
১৯৬৯ সালের শেষের দিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক মীমাংসার ব্যাপারে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন মো. আনিসুর রহমান। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে ‘ইস্ট পাকিস্তান রুটস অব এসট্রেন্জমেন্ট’ প্রবন্ধটি ‘সাউথ এশিয়ান রিভিউ’ নামে লন্ডনের একটি জার্নালে ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান এখন মনে করে যে, সে স্বায়ত্তশাসন পেলেই কেবল নিজের ইচ্ছেমতো তাঁর নিজের ও সামাজিক উন্নয়নের পথ বেছে নিতে পারে, আর এই জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না।’
১৯৭০ সালের মার্চ মাসে ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিল চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তুতি হিসেবে একটি প্যানেল অব ইকোনমিস্ট গঠন করে। তাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ড. আখলাকুর রহমান, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, আজিজুর রহমান খান ও মো. আনিসুর রহমান ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁরা তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের সঙ্গে একেবারেই একমত হতে পারেননি। অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদেরা ছিলেন সোচ্চার।
৬ দফা আন্দোলনকে যাঁরা জনগণের মনে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই অর্থনীতিবিদদের কথা বলতেই হবে। এদের সঙ্গে যুক্ত হবে রেহমান সোবহানের নাম। রাজনীতিকদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন প্রমুখ, সাংবাদিকদের মধ্যে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ছাত্রনেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমদ, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখের নাম থাকবে সর্বাগ্রে। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার কারিগর হিসেবেই বিবেচিত হবেন।
আনিসুর রহমানের দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘পথে যা পেয়েছি’ বইটিতে তাঁর জীবনধারার সঙ্গে পাঠক যেমন পরিচিত হতে পারবেন, তেমনি সে সময়ের রাজনীতি, সামাজিক জীবন, অর্থনীতির কথকতার সঙ্গেও একটা পরিচয় গড়ে উঠবে। গল্পের ছলে তিনি এমন অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যেগুলোয় তাঁর সেন্স অব হিউমার, বিচক্ষণতা, বলিষ্ঠতা ফুটে উঠেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার সদস্য ছিলেন মো. আনিসুর রহমান। সে সময় আমলাতন্ত্রের নানা ধরনের কঠিন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। কী কারণে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা ঠিকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন না, সে বর্ণনা পাওয়া যাবে এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে। এই স্বল্প পরিসর লেখায় তার বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু দুই খণ্ডের বইটিতে রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্র, শিক্ষার্থীদের অনৈতিক আবদার, কৃচ্ছ্রসাধনের পথে প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদির যে বর্ণনা ফুটে উঠেছে, তা স্বাধীনতা-উত্তর দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে অনেকটাই খোলাসা করবে। যাঁর সুযোগ আছে, তিনি এই বইগুলো পড়ে ফেলতে পারেন।
অধ্যাপক আনিসুর রহমান পড়াশোনা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি করেন। পড়াশোনাকে তিনি শুধু তাত্ত্বিকভাবে দেখেননি, বাস্তবজীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করে গেছেন। আমাদের সৌভাগ্য, তাঁর সেই কর্মকাণ্ডের বিবরণ তিনি লিখে রেখে গেছেন।
আমাদের স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত মো. আনিসুর রহমান। দেশের সংস্কৃতি বিকাশের প্রসঙ্গেও তাঁর কথা স্মরণ করতে হবে। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে তাঁর একটি ছবি দেখেছি, যেটি তোলা হয়েছে ১৯৬৪ সালে। জীবন ও সংস্কৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। সৃষ্টির আগুন জ্বালাতে চেয়েছিলেন তিনি। সে আগুন জ্বলেছিল। কিন্তু তা সততা ও নিষ্ঠার ওম পায়নি বলে হারিয়ে গেছে।
১৯৩৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মেছিলেন মো. আনিসুর রহমান। ৯১ বছর অর্থাৎ পরিণত বয়সেই তাঁর প্রয়াণ ঘটল। কিন্তু তারপরও মনে হয়, এই মানুষেরা বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে থাকতে পারতেন। সেই ছায়া দেওয়ার ক্ষমতা যাঁদের ছিল, তাঁরা একে একে চলে যাচ্ছেন। নতুন মহিরুহ কি তৈরি হচ্ছে আর?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা