ইয়ুর্গেন ক্লপের জহুরি চোখ। হিরে চিনতে ভুল করেন না। চশমার ভারী লেন্সের ভেতর দিয়েই যেন পড়ে ফেলতে পারেন অনেক কিছু। অ্যানফিল্ডে কম হিরে-মুক্তো আনেননি। এ মৌসুমে শুরুতে এমন একজনকে এনেছেন, যাঁর উত্থান কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেয় প্রয়াত ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। ‘ফুটবল ঈশ্বরের’ সঙ্গে অবশ্য কারও তুলনা চলে না। তবে দু-এক জায়গায় ম্যারাডোনার সঙ্গে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের সাদৃশ্য টানায় যায়।
সে কী রকম? বলছি—দুজনই আর্জেন্টাইন ও মিডফিল্ডার। সেই মিল তো আছেই। আরও কিছু সাদৃশ্যতা দেওয়া যাক। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব থেকে মূল দলের হয়ে পেশাদারি ক্যারিয়ার শুরু ম্যারাডোনার। ম্যাক অ্যালিস্টারও আর্জেন্টিনোস জুনিয়য়ের যুবদল থেকে মূল দল দিয়ে পেশাদারি ফুটবলে পা রাখেন। আরেক স্বদেশি ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের হয়েও খেলেছেন ম্যারাডোনা। ম্যাক অ্যালিস্টারেরও সৌভাগ্য হয়েছে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাবটিতে খেলার।
জাতীয় দল হোক বা ক্লাব ফুটবল—ম্যারাডোনা মানে যেন ‘১০’ নম্বর জার্সি। ব্রাইটন থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার লিভারপুলে এসে পেয়েছেন এই জার্সি নম্বর। জাতীয় দলে অবশ্য ২৫ বছর বয়সী এই তারকা খেলেন ২০ নম্বর জার্সি পরে। জাতীয় দলে ম্যারাডোনার একমাত্র উত্তরাধিকার যে লিওনেল মেসি! সেই মেসির সঙ্গেই ম্যাক অ্যালিস্টার ২০২২ সালে কাতারে লা আলবিসেলেস্তেদের ৩৬ বছরের দুঃখ ঘুচিয়ে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপ। ১৯৮৬ সালে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতান ম্যারাডোনা।
ছিয়াশির মহানায়ক অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের পাশাপাশি খেলতেন সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে। দুর্দান্ত ড্রিবলিং, রিসিভিং, অসাধারণ পাসিংয়ের পাশাপাশি গোল করার ক্ষমতায় ম্যারাডোনার তুল্য আর কেউ নেই। ম্যাক অ্যালিস্টারও জাত মিডফিল্ডার। খেলতে পারেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। বানিয়ে দিতে পারেন বল। আর গোল করার ক্ষমতা? সেটি গতকাল অ্যানফিল্ডে প্রিমিয়ার লিগের তলানির দল শেফিল্ড ইউনাইটেডের বিপক্ষে যারা দেখেছেন, এতক্ষণে প্রমাণ পেয়ে গেছেন। ২০ গজ দূর থেকে গোলার মতো যে শটটি নিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার সেটি আটকায় সাধ্য কার? ক্লপের চোখে যেটি এখন ‘বিস্ময়কর গোল’। এমন গোলে লিভারপুলের কিংবদন্তি মিডফিল্ডার স্টিভেন জেরার্ডকেও কি মনে করিয়ে দিলেন না আর্জেন্টাইন তারকা?
ম্যাক অ্যালিস্টারকে ভালোবাসে ক্লপ ডাকেন ‘মাক্কা’ নামে। আর এমন এক গোলের পর শিষ্যের প্রশংসায় লিভারপুল কোচ কী বললেন জানেন? সেটিই শুনুন—‘আমাদের মক্কার বিস্ময়কর গোলটির দরকার ছিল। সে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিস্ময়কর খেলোয়াড় ও বিস্ময়কর ছেলে। আমি সত্যিই খুশি যে তাকে আমরা লিভারপুলে পেয়েছি।’
২০২২-২৩ মৌসুমে কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে লিভারপুলকে। বেশ কয়েকজন তারকার চলে যাওয়ার পাশাপাশি চোটের কারণে গত মৌসুম তাদের শেষ করতে হয় ষষ্ঠ স্থানে থেকে। পুরোনো ফর্মে ফিরতে মাঝমাঠে একজন সৃজনশীল মিডফিল্ডারের প্রয়োজন ছিল অলরেডদের। ক্লপের জহুরি চোখে এ জায়গায় ধরা পড়েন ম্যাক অ্যালিস্টার। ব্রাইটন থেকে গ্রীষ্মকালীন দলবদলে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচে নিয়ে আসেন অ্যানফিল্ডে। সেই ব্রাইটনের বিপক্ষে লিগের আগের ম্যাচে মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্সের আরেক প্রমাণ দিয়েছেন ম্যাক অ্যালিস্টার। কিন্তু ক্লপের সঙ্গে তাঁর জুটি আর বেশি দিন দেখা যাবে না। এ মৌসুম শেষেই যে অ্যানফিল্ড ছাড়ছেন জার্মান কোচ!
ম্যাক অ্যালিস্টারের উত্থানটা ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে। পুরো বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ সামলেছেন তিনি। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে হারলেও আলবিসেলেস্তেদের বিশ্বকাপ জেতানোর পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন ম্যাক অ্যালিস্টার। ‘সি’ গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে আর্জেন্টিনার ডেডলক ভাঙা গোলটিও এনে দেন তিনি। আর এ মৌসুমে লিভারপুলের জার্সিতে হয়তো প্রথম প্রিমিয়ার লিগেরও স্বাদ পেতে যাচ্ছেন তিনি। অলরেডদের হয়ে ইতিমধ্যে লিগে ২৫ ম্যাচে করেছেন ২ গোল। আর লিভারপুলের হয়ে সবশেষ ১০ ম্যাচে রাখলেন ১০ গোলে অবদান। তার পাঁচটি গোল, পাঁচটি অ্যাসিস্ট।