নাহ, অলিম্পিক দিয়ে মোহাম্মদ আলী ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ হননি। তবে তাঁর গ্রেটেস্ট হয়ে ওঠার শুরুটা হয় এই অলিম্পিক দিয়েই। লুইসভিলের সেই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটির বর্ণিল ও কিঞ্চিৎ বিতর্কিত যাত্রার বীজটা রোপণ হয়েছিল ১৯৬০ রোম অলিম্পিক দিয়েই। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক শুরুর দুদিন আগে শোনা যাক সে গল্পই।
আলী অবশ্য শৈশব থেকেই কিংবদন্তি হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেন। যাঁরা তখন তাঁকে দেখেছিলেন তাঁদের ভাষ্য, জন্মের পরই বিশাল মাথার কারণে সবার চোখে পড়েন আলী। যা কিনা আর কখনো ছোট হয়নি! ১২ বছর বয়সে আলী প্রথম জিমে যান, যেখানে তিনি তাঁর ট্রেনার ও কোচ জো মার্টিনের দেখা পান। সেই জো না থাকলে ক্যাসিয়াস ক্লে তথা মোহাম্মদ আলীকে হয়তো পাওয়াই যেত না।
এমনকি এই জো না থাকলে আলীর হয়তো ১৯৬০ রোম অলিম্পিকেও খেলা হতো না। রোমের পথে আলীর যাত্রাটা ছিল বেশ মজার। তখনো তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে আলী হয় ওঠেননি। এর মধ্যে গ্লাভস হাতে নেওয়ার ছয় বছর পর লাইট হেভিওয়েট বিভাগে অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান আলী। কিন্তু বিমান চড়ার সাহস ছিল না বক্সিং রিংয়ের ঝড় তোলা এই মুষ্টিযোদ্ধার। এ কারণে রোম অলিম্পিকে না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলেন। শুরুতে অবশ্য চেয়েছিলেন বোটে বা ট্রেনে করে রোম যেতে। কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। আলী তখন বলেছিলেন, ‘খুব খারাপ হলো, আমি তাহলে রোমে যাবই না!’
কয়েক মাস আগে অলিম্পিকের বাছাইয়ের অংশ নিতে ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার সময় মুখোমুখি হওয়া বাজে অভিজ্ঞতার কারণেই বিমানভ্রমণ নিয়ে ভয় জন্ম নেয় আলীর মনে। আলীকে সাহস দিতে এগিয়ে আসেন জো। তাঁকে বোঝান যে, ‘যদি তুমি না যাও, তবে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ হারাবে!’ কোচের এই সব কথায় কাজ হয়, শেষ পর্যন্ত বিমানে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন আলী।
রিংয়ে অবশ্য আলীর দাপট নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ইয়ান বিকাজ, গেনেশি শাটকভ ও টনি মাডিগানকে হারানোর পর আলীর সামনে ছিলেন শুধু বিগিনিও পিটারজাইকোস্কি। অভিজ্ঞতা ও সাফল্যে আলীর চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন পিটারজাইকোস্কি। দারুণ এক লড়াই তাঁকে হারিয়ে আলী ঠিকই সোনা জিতে নেন। এভাবে নিজের আগমনী বার্তাও দিয়ে দেন। এখানেই শেষ নয়।
শুধু রিংয়েই নন, রিংয়ের বাইরেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আলী। নিজের সহজাত মিশুক আচরণ দিয়ে আলী হয়ে ওঠেন ভিলেজের সবচেয়ে আলোচিত মুখ। এ সময় সব মহাদেশের লোক আলীকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেন। তাঁর পরিচিতিই হয়ে উঠে, ‘মেয়র অব দ্য ভিলেজ’ নামে। ১৯৬১ সালে ডেভ কিন্ড্রাড নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেন, ‘ক্যাসিয়াস (আলী) গ্রীষ্মের অলিম্পিক ভিলেজের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন ছিলেন। যিনি সেখানে অনেক বন্ধু তৈরি করেন এবং সব জায়গায় প্রভাব রেখেছেন।’
তবে এসবের মাঝে আলীর অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল মেডেলটি। এক টানা ৪৮ ঘণ্টা যা আলীর গলা থেকে নামেনি। এমনকি ঘুমাতে যাওয়ার সময়ও তিনি এটি নামিয়ে রাখেননি। রাতে ঘুমও খুব একটা ভালো হয়নি। প্রথমবারের মতো তাঁকে পিঠে ভর দিয়ে ঘুমাতে হয়েছিল, যেন মেডেলের কারণে শরীরের কোথাও কেটে না যায়!
কেবল বক্সিং রিংয়েই নয়, আলী সোভিয়েত দেশের সাংবাদিকের সঙ্গেও রোমে লড়াই করে এসেছেন। সোভিয়েতের এক সাংবাদিক আলীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমেরিকায় কিছু রেস্তোরাঁয় কালোদের খেতে যাওয়া নিষেধ থাকার ব্যাপারে। উত্তরে আলী বলেছিলেন, ‘আমার দেশ অনেক বড়। সেখানে যত জায়গায় আমি খেতে না পারি, তার চেয়ে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে আমি যেতে পারি।’
আলী ওয়েটার মেয়েটিকে সব সময় সঙ্গে রাখা মেডেলটাও দেখান। মেয়েটি তাঁর মালিককে এ ঘটনা জানান। সেই মালিকের কাছ থেকেও একই জবাব আসে। সেখানে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন আলী ও কিং।
রক্তাক্ত জামা কাপড় পরিষ্কার করতে অহিও নদীর ধারে চলে আসেন আলী ও কিং। এক সময় তাঁরা জেফারসন ব্রিজে উঠে আসেন। বিষণ্ন আলী গলা থেকে মেডেল খুলে নিয়ে অহিওর জলে ভাসিয়ে দেন। আলী বলেছিলেন, ‘প্রথমবারের মতো মেডেলটিকে আমার সাধারণ কোনো বস্তু বলে মনে হলো।’
যদিও আলীর এই মেডেল ছুড়ে ফেলার ঘটনা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে অনেক তদন্তও হয়েছে। এমনকি আলীর ছোটবেলার এক বন্ধুও মনে করতেন, আলী এটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সত্য যাই হোক, রূপকথা ও বাস্তবতা মিলিয়েই তো ‘গ্রেটেস্ট’ আলী! কখনো কখনো যিনি ইতিহাসকেও ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছেন।