গর্ডন মুর। তাঁকে বলা হয় কম্পিউটার প্রজন্মের উন্নয়নের অন্যতম পথিকৃৎ। গত শুক্রবার (২৪ মার্চ) ৯৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। আরও বহুদিন প্রযুক্তি দুনিয়ায় তাঁকে বারবার উদ্ধৃত করা হবে।
গর্ডন মুর ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে রবার্ট নয়েসের সঙ্গে ইন্টেল করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। মুর তখন অল্প পরিচিত একজন প্রকৌশলী। তিনি ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইন্টেল করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে ইন্টেলের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৯৭ সালে তাঁকে ইন্টেলের চেয়ারম্যান ইমেরিটাস ঘোষণা করা হয়।
মুর ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সাবেক চেয়ারম্যান এবং আজীবন ট্রাস্টি ছিলেন।
১৯৬৫ সালে এক লিখিত নিবন্ধে গর্ডন মুর বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নতিকে ধন্যবাদ। ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট উদ্ভাবিত হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর মাইক্রো চিপগুলোতে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।’ এটিই পরে ‘মুরের সূত্র’ নামে পরিচিতি লাভ করে। মুরের নিবন্ধের পর থেকেই কম্পিউটার চিপগুলো আরও দক্ষ এবং সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে।
মুরের সূত্র অনুযায়ী, প্রতিবছর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে এবং সেই সঙ্গে কম্পিউটারের প্রসেসিং ক্ষমতাও দ্বিগুণ হবে প্রতি দুই বছরে। ইন্টেলের অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুরের দেওয়া এই সূত্র এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই কাজ করছে।
১৯৭০ সালে ইন্টেলের বানানো ইন্টেল ৪০০৪ মাইক্রো প্রোসেসরে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজারের মতো। এখন ইন্টেল কোর আই-৯ প্রসেসরে ট্রানজিস্টর আছে ২৯৫ কোটি!
কম্পিউটিং স্পিডও বেড়েছে একই হারে। ৭৪০ কিলোহার্টজ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ গিগাহার্টজে। মুরের নীতি সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং গবেষণা ও উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণে পথ দেখিয়েছে।
কম্পিউটিং
ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের ট্রানজিস্টরগুলো আরও দক্ষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারও ছোট ও দ্রুততর হয়। চিপ এবং ট্রানজিস্টর হলো আণুবীক্ষণিক কাঠামো যাতে কার্বন এবং সিলিকন অণু থাকে। এই অণুগুলো নিখুঁতভাবে সারিবদ্ধ থেকে সার্কিটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ প্রবাহ করে। একটি মাইক্রো চিপ যত দ্রুত বৈদ্যুতিক সংকেত সংশ্লেষণ করে, কম্পিউটার তত বেশি দক্ষ হয়ে ওঠে। সেমিকন্ডাক্টরের দাম হ্রাসের কারণে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কম্পিউটার নির্মাণ খরচও কমে এসেছে।
ইলেকট্রনিকস
মুরের নীতি থেকে প্রযুক্তির সবগুলো দিকই উপকৃত হয়। স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট কম্পিউটার ক্ষুদ্র প্রসেসর দরকার হয়। এ ছাড়া ভিডিও গেম, স্প্রেডশিট, সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস)—এ ধরনের ডিভাইস ক্ষুদ্র প্রসেসর না থাকলে বানানো সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া কম্পিউটার চিপগুলো আকারে ছোট ও দ্রুতগতির হওয়ায় সামগ্রিকভাবে পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও জ্বালানি উৎপাদনেও বেশ উন্নতি হয়েছে।
মুরের সূত্রের ভবিষ্যৎ
মুরের সূত্র বিগত কয়েক দশক ধরে বেশ কার্যকর হলেও ভবিষ্যতে এটি আর কার্যকর থাকবে না। অল্প স্থানে ট্রানজিস্টরের সংখ্যা একসময় এর সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছে যাবে। গর্ডন মুরের মতেও তাঁর নীতি মোটামুটি ২০২৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এরপর আর সাধারণ পদ্ধতিতে কম্পিউটারের প্রসেসিং প্রতিবছর বাড়ানো সম্ভব হবে না।
প্রসেসর ওভারক্লক শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। ওভারক্লক হচ্ছে কোনো প্রসেসরকে তার নির্ধারিত ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাওয়া। ধীরে ধীরে প্রসেসরের কোর ভোল্টেজ বাড়িয়ে বাড়িয়ে এটি করা হয়। অতিরিক্ত বাড়ানো হলে প্রসেসর পুড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এর পুরো চাপই পড়ে ট্রানজিস্টরের ওপর। এই কাজে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা উন্নতমানের কুলার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বর্তমানে তেমন ওভারক্লক করা যাচ্ছে না। সূত্রানুযায়ী এ সময়ে আমাদের প্রসেসরের ক্ষমতা ৭ গিগাহার্টজে যাওয়ার কথা থাকলেও আমরা ৬ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি।
এসব কারণে অন্য প্রযুক্তি খুঁজে বের করা নিয়ে অনেক দিন ধরেই গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাত্ত্বিকভাবে ১ ন্যানোমিটারের পরের ধারণাই মূলত কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। তবে তা হিমাঙ্কেরও নিচে কাজ করে ফলে তা সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এখনো উপযোগী নয়।
নতুন আর্কিটেকচার ডিজাইন ও অপটিমাইজেশন
প্রত্যেক চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের আলাদা প্রসেসর ডিজাইন রয়েছে। যেমন—ইন্টেলের বর্তমান আর্কিটেকচার x86, এটির ওপর ভিত্তি করে এএমডি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব প্রযুক্তির প্রসেসর বানায়। মোবাইল ফোনের মতো ছোট ডিভাইসের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এআরএম আর্কিটেকচারভিত্তিক প্রসেসর। অ্যাপলও এই এআরএম আর্কিটেকচারভিত্তিক নিজস্ব প্রসেসর ডিজাইন শুরু করেছে।
কীভাবে নির্দেশনা পালন করবে, ডিসিশন মেকিংসহ বিভিন্ন বিষয় প্রত্যেক কোম্পানির প্রসেসর আলাদাভাবে বাস্তবায়ন করে। এ কারণে সমান পরিমাণ ট্রানজিস্টরবিশিষ্ট একটি ইন্টেল চিপ এবং এএমডি চিপের পারফরমেন্স ভিন্ন হতে পারে।
এ ছাড়া এখন মাল্টিকোর প্রসেসর তৈরি নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। সব ধরনের আর্কিটেকচারেই এখন মাল্টিকোর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি মোবাইল প্রসেসরেও মাল্টিকোর প্রযুক্তি থাকছে। অবশ্য এএমডির রাইজেন সিরিজের প্রসেসর আসার আগে মাল্টিকোর প্রসেসর নিয়ে বাজারে তেমন প্রতিযোগিতা ছিল না।
এ ছাড়া বর্তমান জনপ্রিয় ও উন্নতমানের গেমগুলোর কোর অপটিমাইজেশন ৪ বা ৬ কোরের মাঝে সীমাবদ্ধ। সাধারণত গেমিংয়ে সিঙ্গেল কোর পারফরম্যান্স গুরুত্ব বহন করে। ভবিষ্যতে প্রোগ্রাম এবং প্রসেসরগুলো আরও অপটিমাইজড হলে খুব বেশি হার্ডওয়্যারজনিত পরিবর্তন না এনেও কম্পিউটারের পারফরম্যান্স বাড়ানো যাবে।
সিলিকন প্রতিস্থাপন
চিপে সিলিকনের পরিবর্তে অন্য কোনো পদার্থের ব্যবহার করা আরেকটি উপায় হতে পারে। ডেটা বাহক হিসেবে ইলেকট্রনের বদলে অন্য কিছু ব্যবহার—এর একটি বিকল্প হতে পারে। অবশ্য এটা নতুন চিন্তা নয়। ইলেকট্রনের বদলে ফোটন, সিলিকনের বদলে গ্রাফিনের ব্যবহার নিয়ে চলছে গবেষণা। অপটিক্যাল কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ইলেকট্রনের পরিবর্তনে ফোটন ব্যবহার করা হয়।
গুগল, মাইক্রোসফট এরই মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার শুরু করেছে। তবে এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ভোক্তা পর্যায়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি।