নারী উদ্যোক্তা রাইসা রফিক সুলগ্না, থাকেন রাজশাহীতে। ছোটবেলা থেকেই রং নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। রঙের বিষয়ে প্রথম হাতেখড়ি মায়ের কাছে। সেই থেকে মায়ের সঙ্গে নিজের পরিধেয় জামা, ঘরের ব্যবহারের জিনিসপত্র রং দিয়ে রঙিন করে তুলতেন। রঙের প্রতি ভালোবাসা থেকে পড়ালেখা শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে।
সুলগ্না রং ও তুলিতে হ্যান্ড পেইন্ট শাড়িও করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, ‘তখন সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হয়েছি। থাকতাম নিবেদিতা হোস্টেলে। সে বছর হলের দুজন আপু আমার কাছে হ্যান্ড পেইন্টের দুইটা শাড়ি অর্ডার করেন। পরে তাঁদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন আপু শাড়ি অর্ডার করেন। মনে আছে, সেবার আমি এক রাতে ৯টি শাড়িতে আলপনা এঁকে দিয়েছিলাম। আর আমার হ্যান্ড পেইন্ট শাড়িগুলো সবাই অনেক পছন্দও করেছিল। শাড়ি ছাড়াও আমার হাতে আঁকা মাটির সরাও সে সময় অনেকে পছন্দ করেছিল।’
সুলগ্না উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন সংসারজীবন শুরুর আগে থেকে। বিয়ের পর স্বামী মো. রিয়াদ উদ্দিনও উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। তবে সংসারজীবনের কাজের চাপে একপর্যায়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ভুলে যান। পারিবারিক কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন সুলগ্না।
উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে সুলগ্না বলেন, ‘আমি রাত জেগে হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ি করতাম। আমার স্বামী এই শাড়ি দেখে বলেন, “তোমার হ্যান্ড পেইন্ট শাড়িগুলো দেখতে অনেক সুন্দর হচ্ছে। ছোট করে হলেও তোমার নিজের একটা ব্যবসা শুরু করা উচিত। তুমি বড় পরিসরে তোমার কাজ শুরু করো। এতে দিন শেষে কাজ করে শান্তি পাবে। অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে হয়তো মাস শেষে টাকা আসবে; কিন্তু নিজের স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। নিজের স্বপ্নপূরণে নিজেই উদ্যোগী হও। তুমি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করো, আমি পাশে থাকব।”’
বাংলাদেশের একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ বায়োকেমিস্ট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মনিরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয় ‘ড্যাজেল ডেজ মার্ট’-এর এই সাবান। মনিরুল ইসলাম সম্পর্কে সুলগ্নার মামা। দীর্ঘ দুই বছর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যবহারের পর সাবান তৈরির কাজ চূড়ান্ত করা হয়। ‘ড্যাজেল ডেজ মার্ট’ সাবান তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানের মধ্যে রয়েছে নারকেলের তেল, জোজোবা অয়েল (প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার, যা ত্বকের ভেতর থেকে আর্দ্রতা জোগায়), আলমন্ড অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল, পাম অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েল, সান ফ্লাওয়ার অয়েল ও প্রাকৃতিক রং।
এখন যুগ পাল্টেছে। নারীরা ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। অফিস, আদালত, চাকরি, ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন, যা করোনাকালের আগে তেমন চোখে পড়েনি। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঋণসহ উদ্যোক্তা তৈরির কাজে সহযোগিতা করছে। ‘নারী এবং উদ্যোক্তা’ এ বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে সুলগ্না বলেন, ‘আমি সম্প্রতি বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে, আমি পারব। নিজের স্বপ্ন পূরণে নারীকে হতে হবে আত্মবিশ্বাসী। তাহলে কোনো বাধা নারীর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না। আর পরিবার যদি পাশে থাকে, তাহলে তো সমাজের কোনো বাধাকে পথের কাঁটা মনে হবে না।’
গত ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) অধীনে ‘ড্যাজেল ডেজ মার্ট’ নিবন্ধিত হয়েছে। এটা ‘ড্যাজেল ডেজ মার্ট’ পরিবারের জন্য আনন্দের সংবাদ। ভবিষ্যতের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে রাইসা রফিক সুলগ্না বলেন, ‘যাঁরা অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কাজ করতে চাই। অ্যাসিড হামলার কারণে যাঁদের ত্বকের সার্জারি করা হয়েছে, তাঁদের কাছে রূপচর্চার উপকরণ হিসেবে আমার তৈরি সাবান নিয়ে যেতে চাই। যে সাবান তাঁরা নির্ভয়ে, আনন্দের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারবেন। তাঁদের আস্থার জায়গাটুকু অর্জন করে নেবে আমার ড্যাজেল ডেজ মার্ট-এর রঙিন সাবান।’