পরিবারের হাল ধরেছেন নারী উদ্যোক্তা সাদিয়া

মহসিন রেজা, দেওয়ানগঞ্জ
আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২২, ১২: ৪৮
Thumbnail image

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে অধিকাংশ পরিবারের নারীদের বাবা বা স্বামীর অধীনস্থ থাকতে হয়। সংসারের সচ্ছলতা আনতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অর্থ উপার্জন করবে এমন সাধ্য নেই বেশির ভাগ পরিবারের নারীদের।

তবে বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পরিবারের হাল ধরছেন। সাদিয়া তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। নারী উদ্যোক্তা হয়ে দূর করতে পেরেছেন সংসারের অভাব-অনটন। নিজের উদ্যোগে হস্তশিল্পের কাজ করে হয়েছেন স্বাবলম্বী। 

জানা যায়, নেত্রকোনার আটপাড়ার পিতা রেজাউল করিম খান ও মা রানু বেগমের মেয়ে সাদিয়া পারভীন রুনা। আটপাড়া টি এস এস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও বিয়ের পর দেওয়ানগঞ্জ সরকারি আব্দুল খালেক মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচ এস সি পাস করেন। ২০০২ সাল বিয়ের পর চলে যান দেওয়ানগঞ্জের কালিকাপুর এলাকার শ্বশুরবাড়িতে। স্বামী আলী নেওয়াজ ছানা খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে অভাব কাকে বলে বোঝেননি সাদিয়া। শ্বশুর আব্দুস সালাম পেশায় পল্লি চিকিৎসক। স্বামী ও শ্বশুরের আর্থিক অবস্থা সে সময় ভালো ছিল। সে কারণে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও চাকরি করার চিন্তা করেননি তিনি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ভাগ্যের পালাবদল হয়। 

নারী উদ্যোক্তা সাদিয়ার হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান ‘দি সান ফ্যাশন হাউজ’ কাজ করছেন নারী কর্মীরা। নারী উদ্যোক্তা সাদিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালের দিকে চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে সাদিয়ার পরিবার। নিজের পরিবার ও দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সে সময় মনস্থির করেন পরিবারের আর্থিক সংকট দূর করতে কিছু একটা করবেন। ২০১৬ সালের শুরুতে পারভেজ খান ও তাঁর স্ত্রী হাজরা আক্তারের পরামর্শে ও উৎসাহে শুরু করেন হস্তশিল্পের কাজ। প্রথমে বাজার থেকে ৩টি জামার কাপড় কিনে তাতে সুতা দিয়ে নকশি সেলাই করেন। মাত্র ২ হাজার ৭০০ টাকা পুঁজিতে হস্ত শিল্পের ব্যবসা শুরু করেন সাদিয়া। শুরুতে তাঁর নকশি সেলাই করা জামা ৩টি ব্র্যাকের নকশি প্রকল্পের কর্মীরা কিনে নেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সাদিয়াকে। 

স্থানীয়ভাবে হস্তশিল্পের ব্যবসা করে ২ বছরে কয়েক লাখ টাকা পুঁজি হয় সাদিয়ার। পরে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধির চিন্তা করেন তিনি। এ কারণে জামালপুর ছাড়াও নরসিংদী, বাবুরহাট, ঢাকা ইসলামপুর থেকে কাপড় ও সদরঘাট থেকে সুতা পাইকারি কিনতে শুরু করেন। এ ছাড়া হস্তশিল্পের কাজের জন্য দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলা থেকেও কর্মী নিয়োগ করেন তিনি। বিভিন্ন পাইকারি বাজার থেকে নিজেই কাপড়, সুতা কিনে তাতে নিজের ডিজাইন করা নকশি সেলাই করান কর্মীদের দিয়ে। আবার প্রস্তুতকৃত পণ্য চাঁদপুর, নরসিংদী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিক্রি করেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে খুচরা বিক্রির কাজও শুরু করেন। কাজের সুবিধার্থে দেওয়ানগঞ্জ পৌর শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদ আলী মহিলা দাখিল মাদ্রাসার সামনে গড়ে তোলেন ‘দি সান ফ্যাশন হাউস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। 

উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুর গল্পটা সাদিয়ার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি শুরুর দিকে জামালপুর থেকে কাপড় কিনতাম। এ কাপড়ে নকশি ছাপ দিয়ে সেলাই করার জন্য চুক্তিতে এলাকার বেকার নারীদের দিতাম। এ কাজে তারা জন প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করেন। স্বামীর পাশাপাশি নিজেরা অর্থ উপার্জন করে সংসারের অভাব-অনটন দূর করতে পেরে তারা খুবই আনন্দিত। আর এ কারণে হস্তশিল্পের কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়েছেন তারা।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দি সান ফ্যাশন হাউসের সুপারভাইজার কাজলী বেগম বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে ওয়ান পিচ, টু পিচ, থ্রি পিচ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ৮ রকমের নকশি কাঁথা, ৭ রকমের বিছানার চাদর, ছোটদের জামা তৈরি ও নকশি সেলাই করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খুচরা ও পাইকারিতে বিক্রয় করা হচ্ছে। এ হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠানে এখন ১ হাজার ২০০ নারী কর্মী কাজ করছেন।’ 

নারী কর্মীদের কাজ দেখছেন সাদিয়া। সাদিয়ার হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাস আয় হয় প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা। এতে আনন্দিত সাদিয়া। চাকরি না করে কেন হস্তশিল্পের কাজে নিযুক্ত হলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি আসলে চাই, আমার মতো সবাই আয় করুক। সবার সংসারের অভাব দূর হোক। আমি সব সময় দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চাই। ভবিষ্যতে আমার ব্যবসার মুনাফা তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ ব্যবসার পুঁজি বৃদ্ধিতে এবং অন্য একভাগ কর্মীদের জন্য ব্যয় করব।’ 

এ বিষয়ে বালুগ্রামের বিধবা নার্গিস বেগম বলেন, ‘সাদিয়া নেওয়াজ আমাদের পথ প্রদর্শক। তাঁর হাত ধরে হস্তশিল্পের কাজ করে আজ আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। এতে দূর হয়েছে আমাদের সংসারের অভাব-অনটন।’ 

সাদিয়া নেওয়াজর স্বামী আলী নেওয়াজ ছানা বলেন, ‘সাদিয়া কঠোর পরিশ্রম করে আজ স্বাবলম্বী। সাদিয়া শুধু নিজের সংসারের সচ্ছলতা ফিরে আনেননি। পাশাপাশি ১ হাজার ২০০ কর্মীদের পরিবারের সচ্ছলতা এনেছেন। এমন নারী উদ্যোক্তা পরিবার, সমাজ ও জাতির গর্ব।’ 

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নূর ফাতেমা বলেন, ‘সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য সীমাহীন। সাদিয়া নেওয়াজ এ বৈষম্যকে পেছনে ফেলে নিজের উদ্যোগে হয়েছেন স্বাবলম্বী এবং স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছেন অবহেলিত দরিদ্র পরিবারের নারীদের। এ কাজে সামান্য পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এত দূর এসেছেন। আমি সাদিয়ার সফলতা কামনা করি।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত