স্বপ্ন তো কত রকম হয়। সামনে এগোনোর স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন, জয়ের স্বপ্ন ইত্যাদি বড় বিস্তৃত সব স্বপ্নের ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসে ছোট ছোট স্বপ্নের দল। একেবারে নিজের এক ট্রাক আইসক্রিম থাকবে, আর বসে বসে কেবল খাওয়া—এমন স্বপ্ন তো কতজনই দেখেছে শৈশবে। দেখেছে নানা রঙের নানা ঢঙের পোশাকের স্বপ্নও। সময়ের ধুলা জমে এসব স্বপ্ন অনেক সময়ই হারিয়ে যায়, ঝাপসা হয়ে যায়। কিন্তু কেউ কেউ থাকে, যারা এমন সব স্বপ্নকেই ফের জাগিয়ে তোলেন জীবন-জয়ের পথে। তেমনই একজন সুমাইয়া সুলতানা শ্রবণা।
পরিবারের একমাত্র সন্তান সুমাইয়া সুলতানা শ্রবণা বরাবরই স্বাধীনচেতা। সুমাইয়া বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করছেন। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাই অনেক আগে থেকেই নিজের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। টিউশনি করে চালাতেন তাঁর পড়ালেখার খরচ। কিন্তু বাদ সাধল করোনাভাইরাস। গত বছর করোনার সময় স্থবির হয়ে পড়ল পুরো দেশ। সে সময় প্রয়োজনের বাইরে তেমন কেউ ঘরের বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারত না। ফলে সেই কঠিন সময়ে বন্ধ হয়ে পড়ে সুমাইয়ার টিউশনি। এতে তাঁর পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা দেখা দেয়। পরিবারের এই দুঃসময়ে সুমাইয়া ছোটবেলার শখকে পেশা বানিয়ে শুরু করেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘স্বপ্নপিরাণ’-এর যাত্রা।
শেখাটা কিন্তু পরিবার থেকেই। ঢাকার বাসিন্দা শ্রবণার বাবা চাকরিজীবী, আর মা গৃহিণী। না, ভুল বলা হলো। মায়ের বুটিক শপ ছিল। বলা যায়, মায়ের সেই কাপড়-সুতা, আর সুঁইয়েই একটু একটু করে হয়েছে শ্রবণের স্বপ্নের বুনন। সুমাইয়া বলেন, ‘বহু বছর ধরে মায়ের বুটিক শপ ছিল। তাই ছোটবেলা থেকে কাপড়, সুতা, সেলাই মেশিনের শব্দের ভেতরই তাঁর বড় হওয়া। সেই ছোটবেলা থেকে নিজের জন্য নতুন নতুন ডিজাইনের জামা তৈরি করতে ভালো লাগত। পরিবারের কারণে আমি বেশ আগে থেকেই নিজের দায়িত্ব নিজে নিয়েছি। কিন্তু করোনাকালে আমার টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমি বিপাকে পড়ি। টিউশনির টাকা দিয়ে চলত আমার লেখাপড়ার খরচ। করোনাকালে যখন টিউশনি বন্ধ হয়, তখন পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা বেড়ে যায়। তাই সে সময় একদমই শূন্য হাতে শুরু করি স্বপ্নপিরাণ-এর যাত্রা।’
নিজের স্বপ্নের পথে এই যাত্রায় সমালোচনা যেমন শুনেছেন, তেমনি সহযোগিতাও পেয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সহযোগিতা এসেছ মুখ্যত পরিবার ও কাছের বন্ধুদের কাছ থেকে। শ্রবণা বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবারই মোটামুটি সহযোগিতা পেয়েছি। তবে মা ও দুই বন্ধু টুকটুকি, আর অরণির কথা না বললেই নয়। এরা শুরু থেকে আমার স্বপ্নপিরাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নতুন নতুন ডিজাইন করতে মা সাহায্য করেছেন বেশি। ড্রেস তৈরি, আর টেইলরের বিষয়গুলো মা বেশি দেখেন। এ ছাড়া টুকিটাকি কাজে মায়ের সহযোগিতা তো সব সময় পেয়ে এসেছি।’
বলতে বলতে শ্রবণার চোখেমুখে ঠিক সেই আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠল, যা তাঁকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। পরিবারের দুর্দিনে নিজের কাঁধেই কিছু দায় নিয়ে নেওয়ার মতো সাহস এই বয়সী অনেকেরই থাকে না। শ্রবণার সে সাহস আছে এবং অন্যকে স্বপ্নের পথে চালিত করার সাহসও দেখাচ্ছেন তিনি। তাঁর স্বপ্নপিরাণে এখন আরও দুজন কর্মী কাজ করেন। মাত্র ২৫০ টাকায় যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা হয়েছিল, তার মাসিক আয় এখন ৫ হাজার টাকার বেশি। নিজের পড়ার খরচ নিজেই সামলাতে পারছেন তিনি। বললেন, ‘আত্মবিশ্বাসই মূল। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি দরকার। যে নারীর আত্মবিশ্বাস আছে, তাঁর পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব।’
সুমাইয়া সুলতানা শ্রবণা এখনো তাঁর স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। মাত্র চলতে শুরু করেছেন বলা যায়। বলা যায়, এখনো বহু পথ বাকি। তিনি চান তাঁর প্রতিষ্ঠান অনেকের কর্মসংস্থান করবে। চান বহু মানুষের স্বপ্নের আশ্রয় হতে।