ছকেবাঁধা জীবনে কাজ করতে করতে অনেকেই হাঁপিয়ে ওঠেন। তখন নিজের ইচ্ছেমতো জীবনটা সাজাতে না পারার অনুশোচনা দেখা দেয় কখনো কখনো। এতে জীবনে সাফল্য থাকলেও মন খুঁজে বেড়ায় অন্য কোনো কিছুর, যা একান্তই নিজের। যেখানে থাকবে কাজের একাগ্রতা আর ভালোবাসা। জীবনপ্রবাহের কঠিন বাস্তবতায় তেমনি এক পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বাগেরহাটের ঝুমকি বসু।
নারী উদ্যোক্তা ঝুমকি বসুর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার কার্ত্তিকদিয়া গ্রামে। সেখানেই তাঁর শৈশবের দিন কাটে। এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনার জন্য চলে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর স্নাতকোত্তর করেন ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার পাশাপাশি আইন নিয়েও পড়ালেখা করেন। একসময় আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে। এর মধ্যে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পাঁচ বছর চাকরি করার পর সন্তান ‘গদ্য’ জন্মের পর তাঁর পক্ষে চাকরি করা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে ছেড়ে দেন চাকরি।
নারী উদ্যোক্তা ঝুমকি বসুর কাছে রূপসার শুরুর গল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সত্যি বলতে কি, ব্যবসার কথা যখন পরিবারের সদস্যদের প্রথম জানাই, তখন সবাই অনেক অবাক হন। প্রথমে পরিবারের কারও খুব একটা সহযোগিতা ছিল না। এমনকি আমার মা শুনেই বললেন, এত পড়ালেখা করে শেষে তুই গয়না বানাবি? মায়ের এ কথা শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু দমে যাইনি। এরপর পূজার সময় নিজে ডিজাইন করে বাড়ির সবাইকে শাড়ি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্লাউজ ও গয়না বানিয়ে দিলাম। সেগুলো দেখে পরিবারের সবাই খুব প্রশংসা করল। আশপাশের মানুষেরও সমাদর পেলাম। এতে মনে মনে সাহস আরও বেড়ে গেল। অতি আবেগে পরদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুলে ফেললাম একটা পেজ। সময়টা ছিল ২০১৯ সাল। সে বছরের মে মাসে শুরু করলাম অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘রূপসা’র যাত্রা।’
অনলাইন প্রতিষ্ঠানের জন্য কেন রূপসা নামটি পছন্দ করলেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেন “রূপসা” কি আপনার মেয়ের নাম? আমি বলি, হ্যাঁ, রূপসা আমার মেয়ে, আমি রূপসাকে প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছি পরম মমতায়। আবার অনেকে জানতে চান, আপনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বলেই কি আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম রূপসা? এ কথা সত্যি যে, দক্ষিণের মানুষ হিসেবে আমি রূপসার জোয়ার-ভাটা দেখে বড় হয়েছি। তাই এই নদীর ওপর আমার টান থাকবে, তা খুব স্বাভাবিক। এ ছাড়া “রূপসা” নামের এক চমৎকার তাৎপর্য আছে, যা আমার পেজের পণ্যের সঙ্গে মিলে যায়। “রূপসা” শব্দের অর্থ রূপসী।’
উদ্যোক্তার পাশাপাশি ঝুমকি বসু একজন আইনজীবী। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘ সতেরো বছর বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করছেন। এর পাশাপাশি তিনি টুকটাক লেখালিখিও করেন। আগামী বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আসবে ঝুমকি বসুর প্রথম গল্পগ্রন্থ, এমনটাই জানা গেল।
রূপসার শুরুটা কীভাবে হলো আর এখন কী কী পণ্য তৈরি করছেন—জানতে চাইলে ঝুমকি বলেন, ‘প্রথমে কাজ শুরু করি হাতে তৈরি বিভিন্ন গয়না দিয়ে। আমি নিজে টিপ পরতে খুব ভালোবাসি। পেজের প্রথম দিকে টিপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন টিপ হয়ে যায় আমার পেজের সিগনেচার প্রোডাক্ট। এরপর নিজে ডিজাইন করে ব্লকপ্রিন্টের শাড়ি, পাঞ্জাবি, ব্লাউজ ও বাচ্চাদের শাড়িও করতে শুরু করলাম। এ ছাড়া জামদানি ব্লকের মাস্ক করেছি। সেগুলোও অনেকে বেশ পছন্দ করছেন। আবার কাঠের নানা পণ্য যেমন: জুয়েলারি বক্স, কয়েন বক্স, কাঠের সিঁদুর বক্স, মেডিসিন বক্স নিয়েও কাজ করছি।’
উ
দ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা কতটা কঠিন ছিল? ঝুমকি বলেন, ‘কারও কথায় কান না দিয়ে আমার মন যা চেয়েছে তাই করেছি। এখন ব্যবসা আমার নিজের। এখানে সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আমি আমার কাজের সবকিছু তদারকি করতে পারছি। আর ঠিকই সময় বের করে ফেলতে পারছি। সন্তানকে স্কুলে দিয়ে রূপসার বিভিন্ন পণ্য তৈরি করি, ঘুম পাড়িয়ে ব্যবসার নানা কাজ করি। মোটকথা আমি আমার মতো করে সময়টা বের করে নিচ্ছি। এই সুযোগটা চাকরিতে ছিল না।’
সংসারের কাজের পাশাপাশি কীভাবে ব্যবসার কাজে সময় দেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সময় ম্যানেজ করা আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আমার সন্তানকে সব সময় দেখভাল করতে হয়। কারণ, সে এখনো বেশ ছোট। বাসায় তার দেখাশোনা ছাড়াও তাকে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় আমাকে বাইরে গিয়ে কারিগর দিয়ে কাজ করাতে হয়। আবার অনেক সময় বিভিন্ন প্রোডাক্ট সংগ্রহ করার জন্য বাইরে যেতে হয়। সন্তানকে বাসায় একা রেখে আমি বের হতে পারি না, আমাকে অপেক্ষা করতে হয় শুক্রবারের জন্য। আমার স্বামীর অফিস ছুটির দিনে শুধু আমি বাইরের কাজ করতে পারি। আমার পুরোটা সময় যদি আমি রূপসার পেছনে ব্যয় করতে পারতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। কিন্তু সংসার-সন্তান সামলে পুরোটা সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
ঝুমকি বলেন, ‘আমি রূপসার কাজ শুরু করি মাত্র পাঁচ শ টাকা দিয়ে। আর এখন প্রতি মাসে গড় আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে সার্বক্ষণিকভাবে দুজন শ্রমিক আমার সঙ্গে কাজ করছেন। তবে আমার যখন যেমন কাজের চাপ থাকে, সেই অনুযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াই। অনলাইনে বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন মেলায় অংশ নিয়েও আমি ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।’
ঝুমকির স্বপ্ন, ‘রূপসা’ একদিন দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও দাপিয়ে বেড়াবে। সেই স্বপ্নপূরণের ইঙ্গিত অবশ্য মিলছে। দুই বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে শুরু করেছে রূপসার পণ্য। ‘রূপসা’কে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চান ঝুমকি। সেই লক্ষ্যেই চলছে পথচলা।