স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন ফারহানা আফরোজ মুক্তা। খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন নিজে কিছু করার। হয় বড় হয়ে ডাক্তার হবেন, নয়তো বাবার মতো শিক্ষক হবেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হবেন সেটা কখনো ভাবেননি তিনি। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য ২০২০ সালে শুরু করেন অনলাইন ভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘নাহার কুটির’।
‘মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করতে নেই’, ‘পড়াশোনা করে কি হবে’, ‘মেয়ের চাকরি হবে না বিয়ের বয়স শেষ হয়ে যাবে'—মেয়েদের ক্ষেত্রে এ কথাগুলো এখনো আমাদের দেশের অনেক গ্রামের প্রচলিত কিছু কথা। তাই ক্ষেত্রবিশেষে গ্রামের মেয়েদের লেখাপড়া করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ফারহানা আফরোজ মুক্তা যে গ্রামে বসবাস করতেন, সেই গ্রামের পরিবেশ ছিল রক্ষণশীল চিন্তা চেতনার। তবে, তাঁর বাবা স্থানীয় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ায় লেখাপড়া করার সুযোগটা পান তিনি। তা না হলে শৈশবেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেত মুক্তার।
নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুক্তা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি টুকটাক হাতের কাজ করতাম। এ কাজগুলো আমার কাছে নেশার মতো ছিল। যে সময় খেলাধুলার বয়স ছিল, সে সময় আমি এই কাজগুলো নিয়ে বসে থাকতাম। নতুন নতুন জিনিস তৈরি করতে খুব আনন্দ লাগত। এক সময় হারিয়ে গেল আমার ভালো লাগার কাজগুলো। অ্যাডমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, ভাইবা, ফিল্ডওয়ার্ক—এসব কাজে নিজেকে একসময় হারিয়ে ফেললাম। ২০১৯ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে বিয়ে হয়। রংপুরে ছোট্ট একটা সংসার শুরু হয় আমাদের। সংসার চলত নিজেদের টিউশনির টাকায়।’
তবে বাবা-মা সব সময় মুক্তাকে অনুপ্রেরণা দিতেন। তাঁর কথায়, ‘বাবা–মা আমাকে কখনো হতাশ হতে দিতেন না। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি, যখন আমি মাস্টার্স সেকেন্ড সেমিস্টারের ছাত্রী ছিলাম। তখন একদিন ক্লাস এইটের আমার এক ভাতিজির বিয়ের খবর শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। মানে আমাদের গ্রামের মেয়েরা পড়ালেখা শেষ না করেই কম বয়সে সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে নিত। আমার এই এত দূর আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার বাবা-মায়ের। মেয়ের পড়াশোনার জন্য তাদের গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে কটু কথা। কিন্তু আমার বাবা–মা কখনো এসব কথা কানে নিতেন না। আর আমাকেও কোনো কথা শুনতেও দিতেন না।’
মুক্তা জানান, মায়ের নাম নুরনাহার থেকেই ‘নাহার কুটির’ নামটি নেওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি চেয়েছি আমার মায়ের নামে আমাকে সবাই চিনবে। আমার সিগনেচার পণ্য কুশির তৈরি পণ্য। এ ছাড়া আমি কুশির তৈরি বুক কভার, টিস্যু কভার, বিভিন্ন ধরনের টুপি, জুতা, সোয়েটার, মাফলার, বাচ্চাদের জামার গলা, কাঠের গয়না, হ্যান্ড পেইন্ট কুর্তি ইত্যাদি তৈরি করি। এ কাজে সহযোগিতা পেয়েছি জীবনসঙ্গী রাশেদুল ইসলামের কাছে। সে প্রথম থেকেই আমার অনুপ্রেরণা হয়ে পাশে আছে। সুতা কেনা, পণ্য ডেলিভারি, প্যাকেজিং, কালার ম্যাচিং সব কাজেই তাঁকে আমি পাশে পাই। এ ছাড়া আমার ভাইবোন, শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ সব সময় আমার পাশে আছেন। একটা মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি অনেক বড় শক্তি।’
মুক্তার বর্তমানে মাসে আয় হয় পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। আবার সে টাকা দিয়ে বিক্রির জন্য কেনেন নতুন কোনো পণ্য। এইভাবে চলছে তাঁর ‘নাহার কুটির’–এর কাজ।
মুক্তা মনে করেন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেই চাকরি করতে হবে—এমন ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে সবাইকে। তবেই মুক্তি মিলবে বেকারত্ব থেকে। বর্তমানে নারীদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া খুবই জরুরি। সংসার সামলে ঘরে বসেই একজন নারী চাইলে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও আত্মবিশ্বাস।
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে সময়ের সঙ্গে স্বপ্নগুলোও পাল্টে যায়। সেই পাল্টানো সময় থেকে বেরিয়ে এসেছেন মুক্তা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। মুক্তার আশা, তাঁর তৈরি পণ্য দেশে–বিদেশে পরিচিতি পাবে। সব ধরনের হাতের তৈরি পণ্য যুক্ত হবে। আর এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হবে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের।