নুসরাত জাহানের শৈশবের বেড়ে ওঠা ঠাকুরগাঁওয়ের ছোট শহরে। পরিবারের ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট ও ভীষণ আদরের। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল। নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করতেন। নিজে নিজেই তৈরি করতেন নানা রকমের জিনিস। সেসবের মধ্যে ছিল বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ করা সেলাই, ওয়ালমেট ও উলের তৈরি জিনিস। পাশাপাশি ছবি আঁকতেও পছন্দ করতেন তিনি। এই পছন্দের ক্ষেত্র নিয়েই মাত্র ৭০০০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘পসরা’, যা থেকে এখন মাসে লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করছেন নুসরাত।
ছোটবেলা থেকে সৃজনশীল নানা দিকে আগ্রহ থাকলেও সেই চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে কিছু একটা করবেন—এমনটা কখনো ভাবেননি নুসরাত। আট বছরের টানা চাকরিতে নিজেকে যখন এলোমেলো মনে হলো, তখন ২০২০ সালে শুরু করেন অনলাইনভিত্তিক শপিং প্ল্যাটফর্ম ‘পসরা’-এর যাত্রা। পুঁজি ছিল মাত্র ৭ হাজার টাকা।
‘পসরা’-এর কর্ণধার নুসরাত জাহান চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করেন একটা অস্থির সময়ে, যখন দেশে চলছে করোনা মহামারি। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি তখন বেশ এলোমেলো। সে সময় সম্পর্কে নুসরাত বলেন, ‘বলতে গেলে চাকরি জীবনে আমি কখনোই আত্মতুষ্টি পাইনি। সংসার, তিন মাসের সন্তান, চাকরি—সবকিছু মিলে আমার সংসার জীবনের অবস্থা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। জীবনের এই কঠিন সময়েই শুরু করলাম উদ্যোক্তাজীবন। উদ্যোক্তা হিসেবে দেড় বছরের জীবনে আমি পেয়েছি অনেক কিছু। নিজের মতো করে টুকটুক করে সংসারের পাশাপাশি পসরাকে এগিয়ে নিয়েছি। এ সময় খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি।’
অল্প পুঁজি হাতে নিয়েই লড়াইয়ে নেমেছিলেন নুসরাত। বললেন, ‘আমি পসরা-এর কাজ শুরু করেছিলাম ৭০০০ টাকা দিয়ে। এ টাকা দিয়েছিলেন বড় আপু। টাকাটা দেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, “টাকাটা এমনভাবে কাজে লাগাবি যেন এটা তোর সম্পদে রূপান্তরিত হয়। ” আপু আসলে আমার বিপদের কথা ভেবেই এ কথা বলেছিলেন। আমি এই ৭ হাজার টাকা দিয়ে মিরপুরের শাড়ির দোকান থেকে শাড়ি কিনে আমার স্কুলের সহকর্মী ও পরিচিতজনের কাছে বিক্রি করি। বলে রাখা ভালো—আমি গামছা-শাড়ি দিয়ে পসরা-এর কাজ শুরু করেছিলাম।’
নুসরাত এখন সেভাবেই কাজ করছেন। প্রায় সব ধরনের শাড়ি নিয়ে কাজ করেন তিনি। তিনি শাড়িতে নিজেই ডিজাইন করেন। জামদানি, মণিপুরী, কাতান, তাঁতের শাড়ি, বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না নিজের হাতে তৈরি করেন। আবার শাড়ি, গয়নার পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি ও ব্লাউজ নিয়েও কাজ করেন তিনি।
পড়াশোনা শেষে আর দশজনের মতো চাকরিতে ঢুকেছিলেন। চাকরি বলতে শিক্ষকতা। এ পেশার জন্যও যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল তাঁর। নুসরাতের পড়ালেখার শুরু ঠাকুরগাঁওয়ে। ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরিবার থেকে সাহিত্য নিয়ে পড়ার উৎসাহ পান। ভর্তি হন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজে। সেখান থেকেই বাংলা সাহিত্যে অনার্স-মাস্টার্স সমাপ্ত করেন। এ ছাড়া চাকরির জন্য কলেজ নিবন্ধন পরীক্ষা পাস করেন। পরে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাস করেন।
নুসরাত এসেছেনও চাকরিজীবী পরিবার থেকে। শুধু তাই নয়, ব্যবসার প্রতি এক ধরনের বিরাগ ছিল তাঁর পরিবারে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার বরাবরই চাকরিজীবী। ব্যবসা করার বিষয়টাকে পরিবার কখনোই পছন্দ করত না। তাই আমি নিজে সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মানুষ হলেও নতুন কিছু করব—এটা কখনোই ভাবিনি। যদিও ছাত্রজীবন থেকেই শাড়ি ও পোশাকে হাতের কাজ করেছি। একপর্যায়ে আমার আট বছরের চাকরিজীবনে আমি যখন দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সময়টাকে তখন খুব অস্থির মনে হলো। এই কঠিন সময়ে আমার স্বামী আমাকে অনলাইন ব্যবসা শুরু করতে বলে। তাই শান্তি ও স্থিরতা খুঁজে পেতে স্বামীর কথায় রাজি হয়ে সাহস করে নিজেকে গুছিয়ে জবকে টাটা-বাই দিলাম। শুরু হলো আমার পেজ পসরা-এর যাত্রা। অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, (এ ধরনের উদ্যোগ থেকে) পরিচিতরা নাকি কিছু কিনতে চায় না। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি উল্টো ঘটেছে। পসরা থেকে আমার আশপাশের পরিচিতজনেরা প্রতি মুহূর্তে পণ্য কিনছেন।’
আর কিনছেন বলেই খুব অল্প সময়ে পসরা একটা জায়গা করে নিতে পেরেছে। সেভাবে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না দিলেও নুসরাতের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন মানুষ, যাদের উপার্জনও এখন পসরা-এর ভালোমন্দে সঙ্গে জড়িয়ে। প্রতিষ্ঠানের লাভ-ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে নুসরাত বলেন, পসরা থেকে প্রতি মাসে ৮৫ হাজার থেকে এক-দেড় লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। তবে বিভিন্ন উৎসবে আয় আরও বেশি হয়। এখানে ব্লকের কাজের জন্য দুজন, টেইলারিংয়ের জন্য একজন, হাতের কাজের জন্য একজন, আর কেনাকাটার জন্য একজন রয়েছেন। এদের সঙ্গে পসরা চুক্তিবদ্ধ না হলেও তাঁদের কাজের বিপরীতে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
তবে ছোটবেলা থেকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা এবং বাবার গড়ে দেওয়া বই পড়ার অভ্যাস তাঁকে সুফল দিয়েছে। এমন অভ্যাসের কারণেই ভেতর থেকে দৃঢ়চেতা হয়ে বেড়ে উঠেছেন নুসরাত। আর উদ্যোগ গ্রহণ ও তা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর জীবনসঙ্গী বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নুসরাত বলেন, ‘এ দেশের সমাজ বাস্তবতায় নারীরা আসলে অনেক পিছিয়ে। প্রায় সময় শুনতে হয়, “তুমিতো এটা করতে পার না। তোমাকে দিয়ে একাজ সম্ভব না। ” আমি আমার মাকে দেখেছি, এ বিষয়ে হার স্বীকার করেননি। তাই আমিও কখনো হারতে শিখিনি। জীবনের প্রতিটি বাস্তবতায় নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করেছি। আমার জীবনসঙ্গী কখনোই আমাকে ছোট করে দেখেননি। বরং উৎসাহ দিয়েছেন, বিপদে-আপদে পাশে থেকেছেন। ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট ও ভীষণ আদরের। যখন ওরা দেখে—আমি পরিশ্রম করছি, লড়াই করছি, তখন ওরা কষ্ট পায়। আর এ লড়াইয়ে জিতে গেলে, আমাকে সফল হতে দেখলে তারা ভীষণ আনন্দিত হয়।’
নারী হিসেবে অনলাইন ব্যবসা করতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নুসরাতকে। প্রথম প্রথম বেশ মুষড়ে পড়তেন। এখন দৃঢ়তার সঙ্গে বিষয়গুলো মোকাবিলা করেন। নুসরাতে ভাষ্য—‘আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় সত্যি কথা বলতে গেলে সবদিক দিয়েই বাধাগ্রস্ত হয় নারীরা। তাই বলে তো হতাশ হয়ে থেমে থাকা যাবে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, পেজের মেসেঞ্জার বা হোয়াটস অ্যাপে। প্রথমদিকে মন ভেঙে যেত। ভাবতাম এসব কারা করে? মাঝরাতে কারা ফোন দেয়? শাড়ি দেখতে চেয়ে লাইভে অন্য প্রান্ত থেকে বীভৎস কিছু দেখায়; অশ্লীল ছবি পাঠায়। এ ছাড়া শো-রুমে যেহেতু একা থাকি, তার সামনে বহু মানুষ এসে উল্টো-পাল্টা কথা বলে।’
এত সবকিছুর পরও নুসরাত হতাশ নন। নিজের চেষ্টায়, দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে চান। স্বপ্ন ‘পসরা’-কে অনেক দূর নিয়ে যাবেন। যারা সমালোচনা করে, যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নিজের সাফল্য দিয়েই তাদের জবাব দিতে চান নুসরাত।