কয়েক দিন ধরে আলোচনায় শোবিজ শিল্পীদের গোপন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ‘আলো আসবেই’। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর লক্ষ্যে তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং অভিনেতা কাম এমপি ফেরদৌসের নেতৃত্বে ‘আলো আসবেই’ নামের ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়, যেটিতে আওয়ামীপন্থী শিল্পী ও সাংবাদিকেরা যুক্ত ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান ছিল তাঁদের।
সম্প্রতি এই গ্রুপের কিছু চ্যাটের স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এমন একটি স্ক্রিনশটে দেখা যাচ্ছে, এবার্ট খান নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কণ্ঠস্বরের অনুরূপ একটি অডিও রেকর্ডের ফুটেজ শেয়ার করে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কি আসল?’
অডিওতে তারেক রহমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় জনৈক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, ‘লাশ পড়লে, পড়বে। যত লাশ তত তাড়াতাড়ি হাসিনার বিদায়।’
অডিও রেকর্ডটি বিশ্লেষণে দেখা যায, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়েই আন্দোলন, নির্বাচন, সংঘাত ঘিরে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এমন অডিও রেকর্ড ভাইরাল হতে দেখা গেছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, এমন চর্চা দেখা যায় বিশ্বজুড়েই।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন নির্বাচনের মৌসুম। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে দেশটির পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে এক সমাবেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট ও এবারের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লক্ষ্য করে গুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর দেশটির আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কণ্ঠস্বরের অনুরূপ কণ্ঠের একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে। অডিওটিতে ওবামাকে তাঁর প্রাক্তন উপদেষ্টা ডেভিড অ্যাক্সেলরডের সঙ্গে নভেম্বরে আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়। এতে ওবামার কণ্ঠস্বরের মতো একটি কণ্ঠ বলছে, ‘এটি তাদের একমাত্র সুযোগ ছিল এবং এই বোকারা সেটা মিস করল। শুধু ট্রাম্পকে যদি তারা সরিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমরা যে কোনো রিপাবলিকান প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারব।’
গত বছর যুক্তরাজ্যের রাজধানী শহর লন্ডনের মেয়র সাদিক খানও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি এমন ভুয়া অডিওর শিকার হন।
এ ধরনের অডিওকে বলা হয় ‘অডিও ডিপফেক’।
অডিও ডিপফেক সম্পর্কে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের ইনোভেশন টিমের মিডিয়া ও কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ আন্না শিল্ড বলেন, ‘একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করতে যে পরিমাণ ডেটা ও প্রযুক্তির প্রয়োজন, সে তুলনায় স্বল্প ডেটা ও প্রযুক্তি দিয়েই প্রায় বাস্তব অডিও তৈরি করে ফেলা সম্ভব।’
অডিও ডিপফেক তৈরি করা তুলনামূলক সহজ হলেও এটি শনাক্ত করা কঠিন। জার্মানির ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটির মেশিন–লার্নিংয়ের প্রকৌশলী নিকোলাস মুলার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘ভিডিও ডিপফেকের চেয়ে অডিও ডিপফেক শনাক্ত করা একটু বেশি কঠিন, কারণ এ ধরনের অডিও শনাক্তে আমাদের কাছে খুব কম ক্লু থাকে।’
মুলার বলেন, একটি ভিডিও ফুটেজে অডিও, ভিডিও থাকে এবং এ দুইয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে। যার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় ভিডিওটি ভুয়া না বাস্তব। কিন্তু অডিওর ক্ষেত্রে এ ধরনের উপাদান খুবই কম থাকে।
ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটও ‘ডিপফেক টোটাল (Deepfake Total)’ নামে এমন একটি টুল তৈরি করেছে। কোনো সন্দেহজনক অডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এখানে অডিও ফাইলটি আপলোড করতে হবে। টুলটি ‘ফেক–ও–মিটার’ নামে একটি স্কেলের ভিত্তিতে শনাক্ত করে অডিওটি ডিপফেক কিনা।
তবে এটি মনে রাখা দরকার যে, ডিপফেক শনাক্তে এসব টুল শতভাগ নির্ভুল নয়। এ জন্য কেবল টুলের ওপর নির্ভর না করে একাধিক যাচাইকরণ কৌশল ব্যবহার করা উচিত। ডিপফেক অডিও শনাক্তের একটি কৌশল হতে পারে, অডিওতে ব্যক্তির কথা বলার ধরন যাচাই করা। বারাক ওবামার ডিপফেক অডিওটি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নিউজ গার্ড সন্দেহজনক অডিওটির সঙ্গে ওবামার পূর্বের কথোপকথনের রেকর্ড তুলনা করে। শব্দ উচ্চারণের ধরন, বিরতি, শ্বাস–প্রশ্বাসের ধরন, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ ইত্যাদি বিষয় তুলনা করে সন্দেহজনক অডিওটি যাচাই করে তারা।
এর বাইরে সন্দেহজনক অডিওর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও প্ল্যাটফর্ম অনুসরণের পরামর্শ দেয় ডয়েচে ভেলের ফ্যাক্টচেক বিভাগ।