হোম > ফ্যাক্টচেক > আজকের ফ্যাক্ট

মেজর ডালিমের স্ত্রীর ছবি দাবিতে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রীর ছবি প্রচার

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১: ৩৫
আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১: ৩৫

শরিফুল হক ডালিম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা। তিনি মেজর ডালিম নামেই পরিচিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এতদিন তিনি পর্দার আড়ালে ছিলেন। তবে রোববার (৫ জানুয়ারি) বাংলাদেশ সময় রাতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে লাইভে যুক্ত হন।

এরই মধ্যে, শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রী দাবিতে একটি ভিডিওসোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশনে লেখা, ‘জন্মগতভাবেকেউ ভিলেন থাকে না, পরিস্থিতি তাকে ভিলেন বানিয়ে দেয়! আমার নিম্মি হও। আমি তোমার ডালিম হব।’

ভিডিওতে আরও দাবি করা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল শরিফুল হক ডালিমেরস্ত্রী নিম্মিকে বন্দী করে ধর্ষণ করেন। আর এই কারণে মেজর ডালিম ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্টে পুরো শেখ পরিবারকেহত্যা করেন।

নো মোর (No More) নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোববার দিবাগত রাত ২টা ২১ মিনিটে পোস্ট করা ভিডিওটি বেশি ভাইরাল। পোস্টটি সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজারবার দেখা হয়েছে। সাজিদুল ইসলাম বিজয় (Sajidul Islam Bijoy) নামের অ্যাকাউন্ট থেকে লাভার্স অব ব্যান্ড মিউজিক (LOVER’S OF BAND MUSIC) নামের ফেসবুক গ্রুপে করা পোস্টটি ৬ হাজার ২০০ বার দেখা হয়েছে এবং প্রায় সাড়ে চার শ রিয়েক্ট পড়েছে।

এ ছাড়া একই ক্যাপশনে একই ভিডিও একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট হতে দেখা গেছে। এসব পোস্টে কোনো কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে মেজর ডালিমের স্ত্রী নিম্মিকে ধর্ষণ করার বিষয়টি গুজব বলে কমেন্ট করা হয়েছে। আবার কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে তথ্যটি সত্য দাবি করে কমেন্ট করা হয়েছে। রাহুল হাসান (Rahul Hasan) নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘উত্তম জবাব। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যুদ্ধের সময় শেখ পরিবারের লোকেরাই আসল রাজাকার ছিল।’

শুরুতে ভিডিওতে থাকা নারী শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রী কিনা তার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করে আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক বিভাগ। ভিডিও থেকে মেজর ডালিমের স্ত্রী দাবিতে থাকা নারীর দৃশ্যের একটি কি–ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে মেসবাহ খান (Mesba Khan) নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টেছবিটি পাওয়া যায়। ছবিটি ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পোস্ট করা হয়। ছবির ক্যাপশন থেকে জানা যায়, এটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রীর ছবি।

মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পরিবারের ছবি দাবিতে দেওয়া ফেসবুক পোস্ট

রিভার্স ইমেজ সার্চে একই ছবি প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘স্ত্রী মিলি রহমান ও সন্তানদের সঙ্গে মতিউর রহমান।’

এছাড়া, প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে এবং প্রভাত ফেরী নামের একটি নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওই নারীর ছবি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বলে উল্লেখ করা হয়।

শেখ কামাল ও মেজর ডালিমের স্ত্রী সম্পর্কিত তথ্যের সত্যতা আছে কি?

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের ইউটিউব চ্যানেলে রোববার সরাসরি সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে শরিফুল হক ডালিমের বক্তব্যেএ বিষয়ে মন্তব্য পাওয়া যায়।

ভিডিওটির ১ ঘণ্টা ১ মিনিট ২৮ সেকেন্ডে ইলিয়াস হোসেন মেজর ডালিমকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার স্ত্রীকে অপহরণ করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে (শেখ কামাল), গোলাম মোস্তফার ছেলে–কামালের বন্ধু-বান্ধবেরা মিলে, যার বিচার আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে চেয়েছিলেন। ঘটনাটা যদি জানাতেন।’

জবাবে মেজর ডালিম জনান, ১৯৭৪ সালে তাঁর খালাত বোনের বিয়ে ঠিক হয়। সেই বিয়ের পুরো দায়িত্বে ছিলেন মেজর ডালিম এবং তাঁর স্ত্রী। অনুষ্ঠানটি হয় ঢাকা লেডিস ক্লাবে, যা সে সময় ধনী ও প্রভাবশালীদের একটি অভিজাত ক্লাব হিসেবে পরিচিত ছিল।

সেই বিয়েতে মেজর ডালিমের শ্যালক বিদেশ থেকে এসেছিলেন। সেখানে তাঁর শ্যালকের সঙ্গে গাজী গোলাম মোস্তফার দুই ছেলের কথা কাটাকাটি হয়। এই গাজী গোলাম মোস্তফার দুই ছেলে শেখ কামালের বন্ধু ছিলেন। সেই ঘটনার কিছুক্ষণ পর দুটি মাইক্রোবাস এবং একটি কার লেডিস ক্লাবে প্রবেশ করে। মাইক্রোবাসের সঙ্গে ১০–১২ জন অস্ত্রধারী বেসামরিক ব্যক্তি ছিল। তারা প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা আলম এবং চুল্লুকে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর মেজর ডালিমকেও মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। স্ত্রী নিম্মি মেজর ডালিমকে একা যেতে দিতে রাজি না হলে মাইক্রোবাসে তিনি এবং মেজর ডালিমের খালাও উঠে পড়েন। এই ঘটনার পর সবাইকে শেখ মুজিবর রহমানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

অর্থাৎ, রোববার ইলিয়াস হোসেনকে দেওয়া মেজর ডালিমের সাক্ষাৎকার অনুসারে, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে মেজর ডালিমের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বরং তাঁর স্ত্রী ও খালাই তাঁকে একা ছাড়তে চাননি বলে নিজেরাই গাড়িতে ওঠেন। আর এই ঘটনায় শেখ কামালের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা মেজর ডালিম নিজেও উল্লেখ করেননি। সুতরাং, স্ত্রীকে ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে মেজর ডালিম শেখ পরিবারের বেশিরভাগ মানুষকে হত্য করেছেন— এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।

এছাড়া, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার বিষয়ে মেজর ডালিম লাইভ সাক্ষাৎকারের ৩৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের দিকে বলেন, ‘শেখ মুজিব একটি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন। সেখানে দুই পক্ষ থেকেই গোলাগুলি হয় এবং দুইপক্ষেই হতাহত হয়। শেখ মুজিবের পক্ষেরও কিছু লোক মারা যায় এবং সেনা অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষ থেকেও কিছু লোক প্রাণ হারায়। বিপ্লবীরা বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা নিয়ে নেয়।’

সুতরাং, শরিফুল হক ডালিম তথা মেজর ডালিমের স্ত্রী নিম্মির দাবিতে যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, সেই নারী মূলত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী। এ ছাড়া মেজর ডালিমের দেওয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী তাঁর স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টিও সত্য নয়।

রোজাকে বিয়ে করতে গিয়ে মিথিলার কথা ভেবে কাঁদছেন তাহসান— ভাইরাল ভিডিওটির সত্যতা কী

হাসনাত আব্দুল্লাহ দ্বিতীয় বিয়ের দাবিতে ছবি ভাইরাল— প্রকৃত ঘটনা কী

ভারী বর্ষণে আশ্রয়কেন্দ্র প্লাবিত হওয়ার ভাইরাল ছবিটি গাজার নয়