কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলতি মাসের শুরু থেকেই উত্তাল দেশ। এ আন্দোলন ঘিরে ঘটেছে সহিংসতা, ঝড়েছে প্রাণ। একপর্যায়ে পুরো দেশ চলে যায় ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে। গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা সীমিত আকারে সচল হয়। বন্ধ আছে একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া। আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের কাছে একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ফোন কলে যোগাযোগের নতুন নিয়ম নাকি কার্যকর করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত কিছু ‘সরকারি নির্দেশনা’ও নজরে এনেছেন তাঁরা।
এসব নির্দেশনার মধ্যে আছে ব্যবহারকারীদের সব কল রেকর্ড করা হবে, সমস্ত কল রেকর্ডিং সংরক্ষণ করা হবে, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, এক্সসহ (সাবেক টুইটার) সব সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নজরদারি করা হবে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
নির্দেশনাগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই ধরনের নির্দেশনা এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন: ভারত, ঘানা, আরব আমিরাতে ইংরেজি ভাষায় প্রচার করা হয়েছে। সেই নির্দেশনাগুলোই বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে অন্তত ২০২০ সাল থেকে প্রচার হয়ে আসছে।
হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, এক্সের কি নজরদারি করা সম্ভব?
হোয়াটসঅ্যাপ হেল্প সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, হোয়াটসঅ্যাপের বার্তা আদান-প্রদানের সুরক্ষার বিষয়টি এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড অর্থাৎ এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বার্তা আদান-প্রদান করা হলে সেটি বার্তা প্রেরক ও গ্রাহক ছাড়া কারও পক্ষে পড়া, শোনা বা দেখা সম্ভব না। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের পক্ষেও তা দেখা সম্ভব না।
তবে হোয়াটসঅ্যাপ হেল্প সেন্টার বলছে, বিভিন্ন দেশের সরকারি সংস্থাগুলো হোয়াটসঅ্যাপের কাছে ডেটা চেয়ে আবেদন করতে পারে। তবে এসব আবেদনের আইনি বৈধতা থাকতে হয়। হোয়াটসঅ্যাপ নিজেদের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার ‘গভর্নমেন্ট রিকোয়েস্ট ফর ইউজার ডেটা রিপোর্ট’-এ বছরে দুইবার এসব আবেদনের তথ্য প্রকাশ করে। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ কিছু নির্দিষ্ট তথ্য সরকারকে দেয়।
এসব তথ্যের মধ্যে থাকে—
ব্যবহারকারীর প্রাথমিক তথ্য: যেমন, ব্যবহারকারীর নাম, হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট খোলার তারিখ, সবশেষ হোয়াটসঅ্যাপে সক্রিয় থাকার সময়, আইপি অ্যাড্রেস, ব্যবহারকারীর ডিভাইসের ধরন এবং ই-মেইল।
অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য: এর মধ্যে আছে ব্যবহারকারীর অ্যাবাউট সেকশনে দেওয়া তথ্য, প্রোফাইল ছবি, কোনো গ্রুপে থাকলে তার বর্ণনা এবং কনট্যাক্ট নম্বরের বর্ণনা।
মেসেজ এবং কল লগ: সাধারণত হোয়াটসঅ্যাপ এসব তথ্য সংরক্ষণ করে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আইনিভাবে প্রয়োজন হলে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ এসব কল লগ সংগ্রহ করতে পারে। এর মধ্যে আছে ওই ব্যক্তি কার সঙ্গে, কখন, কীভাবে এবং কোন আইপি অ্যাড্রেস ব্যবহার করে যোগাযোগ করছেন।
ফেসবুকের বার্তা আদান-প্রদানের মাধ্যম মেসেঞ্জারে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন সুবিধা শুরুতে ছিল না। তবে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মেসেঞ্জারে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন সুবিধা চালু করে।
ফলে হোয়াটসঅ্যাপের মতো মেসেঞ্জারে পাঠানো বার্তাও সুরক্ষা পায়।
মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স (সাবেক টুইটার) হেল্প সেন্টার সূত্রেও জানা যায়, এই প্ল্যাটফর্মটিরও এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন সুবিধা রয়েছে। ফলে এখানেও সরাসরি বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বার্তা প্রেরক ও গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সেটি দেখা সম্ভব না।
আবার কোনো দেশের সরকারের পক্ষেই ফেসবুককে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেও বিষয়টি উঠে এসেছে। গত বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিটিআরসি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা খেয়াল করেছি যে, এই মুহূর্তে কিছু সামাজিকমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব তারা যেহেতু আমাদের বাংলাদেশের আইনকে কোনোভাবেই মানছে না, আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা কোনো কিছুকেই তারা সম্মান দেখাচ্ছে না এবং তারা তাদের নিজেদের পলিসি গাইডলাইন, প্রাইভেসি সেটিংস নিজেরাই ভঙ্গ করছে। তো এই মুহূর্তে আমরা এই ঝুঁকিটা কীভাবে নেব। তারা এসে যদি সেই প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা এসব বিষয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করবে, তখন আমরা বিবেচনা করে দেখব।’
তবে সরকার বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন ইউজার আইডি বা অ্যাকাউন্ট সম্পর্কিত তথ্য চেয়ে অনুরোধ করেছে। ফেসবুক এসব অনুরোধে সাড়াও দিয়েছে। যেমন, ২০২০ সালে ফেসবুকের কাছে ২৪১টি অনুরোধের মাধ্যমে ৩৭১টি ইউজার আইডি বা অ্যাকাউন্ট-সম্পর্কিত তথ্য চায় বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে ১৪২টি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুরোধ ও ৯৯টি জরুরি অনুরোধ রয়েছে। সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে ৪৪ শতাংশ ক্ষেত্রে তথ্য দিয়েছে ফেসবুক।
বাংলাদেশে কল রেকর্ড
বাংলাদেশে কল রেকর্ড করা হয় কি না এমন তথ্যের অনুসন্ধানে বিবিসি বাংলায় ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন পাস হয়, ২০১০ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে ফোনে আড়ি পাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বিধিমালা অনুসরণ করেই অনেক সময় ব্যক্তির ফোন কল রেকর্ড করে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০২২ সালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের টেলিফোন আলাপের একটি অডিও ফাঁস হয়, পরে এটি তাঁদের দুজনের কথোপকথন বলে সরকার থেকে নিশ্চিতও করা হয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশে কল রেকর্ড করার মতো ঘটনা ঘটে।