মাতৃত্ব, নারীর জীবনের অন্যতম অসামান্য অনুভূতি। মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে শুধু একটি শিশুরই জন্ম হয় না, জন্ম হয় একজন মায়েরও। এ জন্য নারীকে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ। মোকাবিলা করতে হয় নানান শারীরিক-মানসিক পরিবর্তনের। আবার মা হওয়ামাত্রই এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক অবসান ঘটে না। পরবর্তী কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত চলে এই পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট টানাপোড়েন। প্রথমবার যাঁরা মা হয়েছেন, তাঁদের জন্য এই টানাপোড়েন মোকাবিলা করা খুব সহজ নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশ চ্যালেঞ্জিং। নবজাতকের আগমনে পরিবারের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে শিশুটি। মা নিজেও নবজাতকের যত্ন নিতে গিয়ে নিজের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে থাকেন উদাসীন।নবজাতকের প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি মা যাতে নিজের প্রতিও যত্নবান হতে পারেন, সে জন্য সময় ও সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবারের ওপরই বর্তায়।
গর্ভধারণ থেকে প্রসব-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন
একজন নারী গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব-পরবর্তী সময়ে নানান শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। অনেকেই মনে করেন তাঁরা আগের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। নতুন মাকে বোঝাতে হবে গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি এবং অন্যান্য পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক। প্রসব-পরবর্তী শিশুকে স্তন্যপান করানোসহ স্বাভাবিক চলাফেরা ও হালকা কিছু ব্যায়াম করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তিনি আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন। প্রসবের পর নতুন মায়েরা সাধারণত কিছু শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন। সেগুলো হলো:
শরীরে ফাটা দাগ
গর্ভাবস্থায় শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির কারণে প্রসবের পর নারীর শরীরের অনেক অংশে, বিশেষ করে পেটে ফাটা দাগ দেখা যায়। এ নিয়ে প্রায় সব মা-ই অস্বস্তিতে ভুগে থাকেন। এসব ফাটা দাগ দূর করার জন্য অলিভ অয়েল অতুলনীয়। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে দাগের ওপর অলিভ অয়েল মালিশ করুন এবং সকালে গোসল করে ফেলুন। এতে ত্বক যেমন মসৃণ হবে, তেমনি
দাগও হালকা হতে শুরু করবে। অলিভ অয়েল ছাড়াও বাজারে রয়েছে নানা রকম অ্যান্টি স্ট্রেচ-মার্ক ক্রিম। এগুলো ব্যবহারেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
পেশির শিথিলতা
স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসবের পর অন্তত দেড় মাস এবং সিজারিয়ান সেকশন হলে অন্তত ছয় মাস কোনো ধরনের ভারী ব্যায়াম করা উচিত নয়। তবে প্রতিদিন কিছু সময় হাঁটলে এবং হালকা ব্যায়াম করলে উপকৃত হবেন। এই হাঁটাহাঁটি শুরু করা যায় প্রসবের একেবারে তিন থেকে চার সপ্তাহ পরেই। তলপেটের চামড়া, পেশি ও অঙ্গগুলোকে পুনরায় দৃঢ় করার জন্য পেলভিক এক্সারসাইজও শুরু করতে হবে একবারে প্রথম দিকেই।
ওজন বেড়ে যাওয়া
বুকের দুধ পান করালে মায়ের প্রচুর ক্যালরি খরচ হয়। তাই বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের ওজন কমানোর ভালো উপায়। এটি শুধু শিশুর জন্যই যে দরকার তা নয়; নতুন মায়ের প্রয়োজনীয় মানসিক, শারীরিক ও হরমোনগত পরিবর্তনের জন্যও যথেষ্ট সহায়ক।
চোখের নিচে কালি পড়া
প্রসব-পরবর্তী হরমোনের পরিবর্তন এবং পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের অভাবে নতুন মায়ের চোখের নিচে কালো দাগ ও ফোলা ভাব দেখা দেয়। নবজাতকের দেখাশোনায় পরিবারের সবাই মিলে সহযোগিতা করলে এবং মাকে পরিমিত বিশ্রাম ও ঘুমের সুযোগ করে দিলে এই সমস্যা দ্রুতই মিটে যাবে।
ত্বক ও চুলের যত্ন
পর্যাপ্ত পানি পান করুন। এতে ত্বক সতেজ থাকবে এবং ত্বকের ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসবে। সময়মতো ও সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস নতুন মায়ের ত্বক ও শরীরকে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। গর্ভাবস্থায় বা সন্তান জন্মের পর শরীরে উচ্চ প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা ব্রণ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বাদামি বা কালো ছোপ ছোপ দাগ তৈরি করতে পারে। গর্ভাবস্থার পর এই হরমোন ধীরে ধীরে কমে যায় বলে দাগগুলোও ধীরে ধীরে মুছে যায়। ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। চুল ও ত্বকের যত্নে চিকিৎসকের পরামর্শে ভিটামিন ও মিনারেলস খেতে পারেন।
মানসিক অবসন্নতা
অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি নতুন মায়েরও কিছু দায়িত্ব আছে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক (গাইনি) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ