২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাকের মসুল ছিল আইএসআইএস গোষ্ঠীর প্রধান লক্ষ্য। সে সময় ওই গোষ্ঠীটি স্বঘোষিত ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিল। তবে মসুল থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের বিতাড়িত করা হলেও এই অঞ্চলটিতে যুদ্ধের ক্ষত এখনো রয়ে গেছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত মসুলের ক্ষত সারাতেই একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন এক শিক্ষাবিদ। এটি মূলত বাসের মধ্যে নির্মিত একটি মোবাইল লাইব্রেরি। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষা এবং আশা ছড়িয়ে দিচ্ছে এই লাইব্রেরিটি।
আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, উদ্যোগটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল-জাবার সুলতান ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান। তিনি মনে করেন, অজ্ঞতার জন্যই বিগত বছরগুলোতে মানুষ যুদ্ধ এবং ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। কারণ, শিক্ষা এবং জ্ঞানের প্রবাহ না থাকলে সমাজের মধ্যে উগ্রবাদ ও চরমপন্থা বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, ‘আজকাল, একজন শিক্ষিত ব্যক্তিকে প্রভাবিত করা কঠিন।’
গত নভেম্বরে শুরু হওয়া সুলতানের উদ্যোগটি মসুলের বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে ডিজাইন করা হয়েছে। মূলত নির্দিষ্ট সময় পরপর এই লাইব্রেরি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে হাজির হয়। কোনো শিক্ষার্থী চাইলে এই লাইব্রেরি থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ দিনের জন্য বই ধার নিয়ে পড়তে পারেন।
সুলতান বলেন, ‘আমরা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বইগুলো বাদ দিয়েছি। কারণ, এটি এখন শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত সময় নয়।’
লাইব্রেরিতে প্রায় এক হাজার বই রয়েছে। এই বইগুলো মূলত সংস্কৃতি, দর্শন, বিজ্ঞান, সামাজিক ও সাহিত্য বিষয়ে। কাঠের তাকগুলোতে থরে বিথরে সাজানো রয়েছে বইগুলো।
আরেকটি বিষয় হলো লাইব্রেরির বাসটি সোলার প্যানেল দিয়ে চালিত এবং এতে ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সুবিধাও রয়েছে। ফলে পাঠকেরা ওই লাইব্রেরি থেকে বিশ্বের কোটি কোটি বইয়ের অ্যাকসেস নিতে পারেন।
সুলতান বলেন, ‘নিনেভেহ (মসুল প্রদেশের রাজধানী) এবং বাগদাদ ছিল জ্ঞানের আলোকবর্তিকা। এ জন্য আমরা আমাদের বাসটিকে একটি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা বানানোর চেষ্টা করছি।’
২০১৬ সালে আইএসআইএসের কাছ থেকে মসুল পুনরুদ্ধারের জন্য ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহুরে যুদ্ধের সূত্রপাত করেছিল। ২০১৭ সালে যুদ্ধটি সফলভাবে শেষ হয়।
কিন্তু এই বিজয় অর্জনে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং শহরের অসংখ্য ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। যুদ্ধের ফলে একদিকে বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বহু গ্রন্থাগার, বই এবং পুরোনো পাণ্ডুলিপি ধ্বংস হয়ে গেছে।
আইএসের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক সংস্থা মসুলের সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সুলতান বিশ্বাস করেন—বিগত বছরগুলোতে শুধু পাথরের ধ্বংস নয়, চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানও ধ্বংস হয়েছে। একটি সমাজের মেধাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল উগ্র ও চরমপন্থা।
মূলত জার্মানি সফরে গিয়েই মোবাইল লাইব্রেরির ধারণাটি পেয়েছেন সুলতান। তবে এই উদ্যোগটি নিজ দেশে শুরু করতে গিয়ে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। বিশেষ করে অর্থের অভাব, বই সংগ্রহ করা এবং জার্মানির কাছ থেকে বাস আমদানির ক্ষেত্রে সরকারি বিধিনিষেধও এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার ডলারসহ অন্যান্য দাতার সহযোগিতায় ৩০ হাজার ডলারের একটি তহবিল গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন সুলতান। পরে তিনি একটি পুরোনো ৪০ আসনের বাস ক্রয় করেন। এই বাসটিকেই লাইব্রেরিতে রূপান্তর করা হয়েছে।
দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, সুলতানের উদ্যোগটি স্থানীয় মানুষের কাছে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকেই এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন। সুলতান বলেন, ‘আমি কল্পনাও করিনি, উদ্যোগটির প্রতি মানুষ এতটা সাড়া দেবে। এখন অনেক স্কুল থেকেই বাসটির হাজিরার জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হচ্ছে। আমাদের একটি পাঠক দলও রয়েছে, যারা আমাদের গতিবিধি অনুসরণ করে।’
সুলতান আরও বলেন, ‘একটি সমাজ যখন বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং সমাজকল্যাণে শিক্ষিত হয়, তখন রাজনীতিবিদেরা, ধর্মীয় বা উপজাতীয় নেতারা এই সমাজকে প্রভাবিত বা প্রতারণা করতে পারবে না। কারণ, ওই ব্যক্তিরা তাঁদের শক্তি পান শুধু অজ্ঞতা থেকে। যত বেশি অজ্ঞতা, তত বেশি তাঁদের প্রভাব।’