হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% শুল্ক: করণীয়

আবু তাহের খান 

সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে আগের ১৫.৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও ইসরায়েলের ক্ষেত্রে আরোপিত এ শুল্কহার হচ্ছে যথাক্রমে ৩৪, ২৬, ২৯, ৪৬, ৪৪ ও ১৭ শতাংশ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এ দফায় দায়িত্বভার গ্রহণের আগে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েই ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই যুক্ত হয়েছিল রাশিয়া ও কানাডা। অবশ্য পরে রাশিয়া ও কানাডার ওপর থেকে তা বহুলাংশে কমিয়ে আনা হয়। তবে এ দফায় যেভাবে তিনি চীনসহ অনেক দেশের ওপর একযোগে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিলেন, তাতে করে বাংলাদেশসহ সেসব দেশের রপ্তানিকারক, সরকার, এমনকি সাধারণ জনগণের অন্তরাত্মাও একসঙ্গে কেঁপে উঠেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে এ হারের ক্ষেত্রে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানোর এখনো যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা দুই-ই রয়েছে এবং পৃথিবীর অনেক দেশই যে তা করে কিছুটা হলেও সফলকাম হবে, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক দূতিয়ালির মাধ্যমে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে কতটা কী করতে পারবে, সেটাও ভাবনার বিষয়। উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ হার কমিয়ে আনা হবে।

বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির বার্ষিক পরিমাণ এখন কমবেশি সাড়ে ৮০০ কোটি ডলারের মতো। ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে প্রকৃত পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮৫৮ কোটি ডলার ও ৭৩৪ কোটি ডলার। ২০৩০ সাল নাগাদ এ পরিমাণকে ১ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে ইতিপূর্বে প্রদত্ত ঘোষণায় দাবি করা হয়েছে। এ অবস্থায় বর্ধিত আমদানি শুল্ক আরোপসংক্রান্ত ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার হয়তো ওই লক্ষ্যমাত্রা বহাল রাখা নিয়ে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তা বোধ করবে। আমার অভিমত হচ্ছে, বিষয়টি দুশ্চিন্তার হলেও লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ফেলাটা মোটেও সমীচীন হবে না। বরং লক্ষ্যমাত্রা অক্ষুণ্ন রেখে কীভাবে তা অর্জন করা যায়, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবা জরুরি। তবে তা করতে গিয়ে কোনোভাবেই এ পরিস্থিতিকে করোনাকালীন বা ইউক্রেন যুদ্ধের সময়কার মতো সুবিধা ও ফায়দা লোটার অছিলা হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যা করার আশঙ্কা যথেষ্টই রয়েছে।

বাংলাদেশের গত সাড়ে পাঁচ দশকের উদ্যোক্তা-সংস্কৃতি বলে যে, ট্রাম্পের এ উচ্চ শুল্কহার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা, বিশেষত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের শিগগিরই সরকারের কাছে বাড়তি নগদ প্রণোদনা, কর হ্রাস, ঋণের সুদ মওকুফ ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার দাবি উত্থাপনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর ব্যবসায়ী ও আমলা প্রভাবিত সরকার যে তাদের সেসব দাবিদাওয়ার প্রতি যথেষ্টই সহানুভূতিশীল হবে, সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে সে আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক, সেটি শুধু কাম্যই নয়—দেশের জনগণ ও অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে অপরিহার্যও। কিন্তু ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার সে অপরিহার্যতা রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বা রাখতে পারবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী বাণিজ্য উপদেষ্টার প্রতি বিনীত অনুরোধ—ব্যবসায়ীদের স্বার্থ অবশ্যই দেখতে হবে, তবে তা কোনোভাবেই দেশ, জনগণ ও অর্থনীতির সামগ্রিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে নয়। অনুরোধ থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কহার মোকাবিলার জন্য দয়া করে নগদ প্রণোদনা বৃদ্ধির দিকে ঝুঁকবেন না। বরং প্রণোদনাবহির্ভূত অন্য ক্ষেত্রগুলোতে গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করাই হবে উত্তম পন্থা। কিন্তু তা না করে যদি নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর দিকে যাওয়া হয়, তাহলে বিপুল রাজস্ব ঘাটতির এ দেশে সেটি হবে স্পষ্টতই একটি জনস্বার্থবিরোধী উদ্যোগ।

আর সে ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন ক. দেশের সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরগুলোতে বিরাজমান অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা ও দীর্ঘসূত্রতা দূরীকরণের মাধ্যমে পরিবহন-সময় ও পরিবহন-ব্যয় কমিয়ে আনা; খ. কর ও শুল্কসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলোকে উদ্যোক্তা-স্বার্থের অনুগামী করে ঢেলে সাজানো; গ. রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), ব্যবসায় উন্নয়ন পর্ষদ (বিপিসি) ও রপ্তানিসংশ্লিষ্ট অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের বাড়তি তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা; ঘ. রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানিকে সহজতর করার লক্ষ্যে আমদানি প্রাপ্যতা (এনটাইটেলমেন্ট) নির্ধারণ, ঋণপত্র (লেটার অব ক্রেডিট-এলসি) খোলা, শুল্কের পরিমাণ নির্ধারণ, পণ্য খালাস ইত্যাদি কাজগুলোকে হয়রানিমুক্ত ও ত্বরান্বিত করা; ঙ. অভ্যন্তরীণ পরিবহনব্যবস্থাকে চাঁদাবাজি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত রাখা ইত্যাদি।

বিরাজমান কাঠামোর আওতায় ওপরে যেসব সংশোধন ও সমন্বয়মূলক (অ্যাডজাস্টমেন্ট) ব্যবস্থাদির কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলোর অধিকাংশই তাৎক্ষণিক প্রকৃতির। এর বাইরে রপ্তানি উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা থেকে এসবের পাশাপাশি অন্য যেসব ব্যবস্থাদির কথা জরুরি ভিত্তিতে ভাবা প্রয়োজন, সে-সংক্রান্ত কতিপয় প্রস্তাবও রাষ্ট্রের বিবেচনার জন্য এখানে তুলে ধরা হলো। এক. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি পণ্যের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করতে হবে। দুই. তৈরি পোশাকের বাইরে নতুন রপ্তানি পণ্য খুঁজে বের করতে হবে, যেগুলো রপ্তানি মাধ্যমে তৈরি পোশাকের ওপর থেকে একক নির্ভরতা হ্রাস করা সম্ভব হবে (বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই)। তিন. ওষুধ, চামড়াজাত দ্রব্যাদি ও এ-জাতীয় রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে, যেগুলো তাদের উচ্চ মূল্যমানের কারণে স্বল্প রপ্তানি করেও দ্রুত আয় বাড়াতে সক্ষম। চার. পণ্যের গুণগত মান ও উৎপাদনশীলতা উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের তাগিদ ও সহায়তা দুই-ই দিতে হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে ইচ্ছুক বিভিন্ন পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকলেও তাতে আতঙ্কিত হওয়াটা মোটেও সমীচীন হবে না। বরং আতঙ্কিত না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এ শুল্কহার কার্যকর হওয়ার আগেই তা কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। আসলে মানদণ্ডটিই এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বরাজনীতি সফলতা পায়। আর সে কারণেই ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ শুল্কহার ৪৬, ৪৪ ও ৩৭ শতাংশ হলেও ইসরায়েল বা যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে তা মাত্র ১৭ ও ১০ শতাংশ। তাই কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর সময় এ বিষয়গুলোকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তুলনা (রেফারেন্স) হিসেবে টেনে আনতে হবে। তদুপরি ট্রাম্পের এসব একতরফা পদক্ষেপ যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর স্বাক্ষরিত কোনো কোনো প্রটোকলের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, সেটিও উল্লেখ করতে হবে।

মোটকথা, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে মোকাবিলা করতে হবে অতি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে।

হায়রে ফিলিস্তিন, জানেন না এখানে কী হয়েছে

খই ফোটা

বাঙালি মধ্যবিত্তের ভালো-মন্দ

এত চাপ কি সামলাতে পারবেন ট্রাম্প

ফিলিস্তিন নিয়ে আরব নেতাদের নীরবতা

ট্রাম্পের শুল্কনীতির খাঁড়ায় বাংলাদেশ

তৌহিদি জনতা কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী

নেতার হাঁচি

পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন কী মিলবে

নববর্ষের আগাম সুখবার্তা