দুর্নীতি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যে খানা জরিপ করেছে, তাতে নতুন করে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। চিরাচরিতভাবেই ঘুষের আদান-প্রদানের খবরগুলো জানা গেছে। এবং বাস্তবতার হেরফের না হলে সরকারি অফিসগুলোয় এই লেনদেন অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
এই আশঙ্কা করতে হচ্ছে কারণ সরকারি অফিসগুলো যে ঐতিহ্য নিয়ে চলে, তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই ধারণা পোষণ করেন, অবৈধ আয় তাঁদের জন্মগত অধিকার। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে এই উপরির কারবার চলে আসছে বলে সেবার সঙ্গে ঘুষের একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ সরকারি বিভিন্ন সেবা নিতে গেলেই তা টের পান। টিআইবির খানা জরিপে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সেবা খাতে জাতীয় পর্যায়ে মোট ঘুষের ন্যূনতম প্রাক্কলিত পরিমাণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এই সময়ে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ঘুষের শিকার ৫০.৮ শতাংশ পরিবার বা খানা। অর্থাৎ যাঁরাই সেবা গ্রহণ করতে গেছেন, তাঁদের অর্ধেকের বেশি দুর্নীতির শিকার হয়েছেন কিংবা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই ট্রাডিশন শুধু গালভরা বুলিতে পাল্টাবে না। অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে, সংস্কারে হাত দিয়েছে কিন্তু সরকারি সেবা খাতগুলো তাতে আড়মোড়া ভেঙে দেশপ্রেমী হয়ে উঠে উপরির আশা ছেড়ে দেবে—এ রকম ভাবনায় স্থির হওয়ার মতো কোনো আলামত এখনো দেখা যাচ্ছে না। বরং আগের নিয়মেই যে ঘুষের কারবার চলছে, তা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে।
যে খাতগুলোয় দুর্নীতি পাহাড়প্রমাণ, তার মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএর মতো সংস্থাগুলো। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বিচারিক সেবা পেতেও প্রচুর বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। ‘বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ প্রবাদটির জন্মও নিশ্চয়ই অকারণে হয়নি। আর পাসপোর্ট অফিস? যিনি দালাল না ধরে নিজের পাসপোর্টের জন্য নিজে দরখাস্ত করেছেন, তাঁকে যে কত ধরনের নাকানি-চুবানি খেতে হয়, তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। আর দালাল ধরা মানেও তো ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’। কড়ি ছাড়া তেল মাখা সম্ভব নয়। ভূমি সেবা তো অন্য সব সেবাকে হার মানিয়েছে। এখানে নাকি ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়েই না।
এই বাস্তবতা থেকে বের হয়ে আসার উপায় খোঁজা হয় বটে, কিন্তু আরামসে বাড়তি অর্থ রোজগারের সুযোগ থাকলে কেন বিবেককে কাজ করতে দেবেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। সেবা খাতে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাসহ সরকারের কাছে ৯ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। সেবাব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করার কথা রয়েছে তাতে। কিন্তু ওই যে বললাম, আগে তো বদলাতে হবে মানসিকতা, নইলে ঘুষের কারবার বন্ধ হবে কী করে?