মোস্তাফিজুল হক
বিকেলে ছোট খালা এলেন। মা আমাকে চুপিচুপি বললেন, ‘খোকা, বাজারে যা। ঘরে তেমন কিছু নেই। তোর খালা দুই দিন থাকবে। আজ হাটবার। বুধবারের আগে আর হাট বসবে না। ভালো দেখে একটা পদ্মার ইলিশ আর কিছু সবজি নিয়ে আয়। মাংস লাগবে না, ঘরের মুরগি দিয়ে চলবে।’
তেঁতুলতলা বাজারে তিন দিন হাট বসে। দুপুরে বাজার জমতে থাকে; সন্ধ্যায় শেষ হয়। প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের হাট। বিকেল সাড়ে ৫টা বলে তড়িঘড়ি করে রওনা দিলাম। বাজারে ঢুকতেই মাগরিবের আজান পড়ে গেল। ভালো দেখে একটা ইলিশ, কচুর মুখি, কাঁচকলা আর আমন ডাঁটা কিনে নিলাম। পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ আর সেমাইও কিনলাম। জগদীশ কাকার গুড়ের জিলাপি খাই না বহুদিন। এক কেজি জিলাপি কিনে নিলে মন্দ হয় না, মা বরং খুশিই হবেন।
‘আরে! খোকন! তোমার কি আমার কথা মনে আছে?’
কাকা, মনে থাকবে না কেন? বাবা মারা গেলেন, কলেজেও ভর্তি হলাম। এখন আর অবসর কই?
কাকা এক কেজি জিলাপি প্যাকেট করলেন। ‘এক মিনিট বসো’ বলেই গরম জিলাপি এনে বললেন, ‘এটা খাও; দাম নেব না।’ ঠিক তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। এদিকে তাড়াহুড়ো করে বাজারে আসায় ছাতা আনা হয়নি। বাধ্য হয়েই চুপচাপ বসে থাকলাম।
রাত সাড়ে ৮টায় বৃষ্টি থামল। বাজারে তীব্র লোডশেডিং। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। ঘন জঙ্গলে ঘেরা পায়ে হাঁটা কাঁচাপথ। সঙ্গী হিসেবে কাউকে পেলাম না। শুনেছি শ্মশানঘাটে ভূত আছে। ভূতেরা পথিকের বাজার কেড়ে নেয়। রাত করে ফিরলে আর রক্ষা নেই।
লোকমুখে শোনা যায়, ভূতেরা নানা সাজে বের হয়। কখনো মাথায় শিং, নয়তো লম্বা জোব্বা পরে হুজুর সেজে পথ আগলে দাঁড়ায়। ওগুলো নাকি মামদো ভূত। যেদিন একা বের হয়, সেদিন নাকি জিনের বাদশাহ সেজে বের হয়।
ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে একাই পথ হাঁটছি। শুনেছি মামদোরা সাত ভাই। আজ নিশ্চয়ই পেছন থেকে থাপ্পড় মারবে। তারপর ইলিশ মাছ আর জিলাপি কেড়ে নেবে।
দরবেশ সেজে বের হলে পেছন থেকে ডেকে বলে, ‘ভাইসাব, শুনছেন? একলাই এই পথ ক্যাম্নে হাঁটছেন? এই পথে ভূতের ভয় আছে। আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো। চলেন, গল্প করতে করতে চলি।’
এভাবেই পথিককে বোকা বানিয়ে ভুল পথে নিয়ে যায়। তারপর মুহূর্তেই চেহারা পাল্টে দানবের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। চোখ দুটো টকটকে লাল করে বুকে কাঁপন তোলে। ঠাঠা করে হাসতে হাসতে চারটে বড় বড় দাঁত বের করে। হাতের বড় বড় ধারালো নখ বের করে বুক ফেঁড়ে ফেলতে চেয়ে বলে, ‘এই, তোর সব মাছ আমার হাতে তুলে দে!’ শুনেছি ওরা নাকি সবকিছুই লুটে নেয়। একটা বিষয় আমার মাথায় ধরে না, ভূত বা জিনেরা টাকাপয়সা নিয়ে কী করে?
নানা রকম চিন্তা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে কীভাবে পথ হাঁটছি, তা নিজেও জানি না। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। ঝাঁপটা বাতাস বইছে। তবুও শরীর ভিজে ঘাম ঝরছে। পেছনের আবছা আঁধারে কে যেন কদমগাছের নিচ থেকে উঠে এসে সঙ্গী হতে চাইছে। আবছায়া মূর্তিটা অনুভব করলেও পেছন ফিরে তাকাই না।
‘খোকন, দাঁড়া?’ হঠাৎ করে নাম ধরে ডাকতে শুনে ভয়ে চমকে গেলাম। মনে মনে ভাবছি, মামদো ভূত নাকি জিনের বাদশা ডাকল তবে? পেছন ফিরে দেখি বেশ লম্বা সুঠাম দেহের ছায়ামূর্তি। ঠিকমতো মুখ দেখা যাচ্ছে না। সাহস করে বললাম, কে আপনি?
—‘তোর মা তোকে এগিয়ে নিতে পাঠিয়েছেন।’
—মুখ আড়াল করে রেখেছেন কেন?
—‘কেন? আমাকে ভূত মনে হয় নাকি? বেশ, তাহলে মুখটা ভালো করে দেখাই।’
কাপড় সরাতেই দেখি অদ্ভুত দর্শন দানব! ভয়ে অজ্ঞান প্রায় আমি। হঠাৎ আরও সাতজন লোক এসে দৈত্যটাকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন দৈত্যের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, ‘এই, ওর মুখোশটা খোল।’ মুখোশটা খুলতেই আর চিনতে বাকি রইল না, এ যে উত্তরপাড়ার বাদশা ভাই! তবে তিনিই কি এত দিন জিনের বাদশা সেজে এসব মামদোবাজি করেছেন?