লাগামহীনভাবে সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে চলছে ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন। সরবরাহ লাইনে মোটর সংযোগ দিয়ে পানি টেনে নিয়ে ট্যাংকে ‘রিজার্ভ’ (সংরক্ষণ) করছেন বহুতল ভবনের মালিকেরা। সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এ রকম অনিয়মের কারণে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যশোর পৌরসভার নাগরিকদের বড় একটি অংশ। বছরের পর বছর ধরে এমনটি চললেও এটি বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না পৌর কর্তৃপক্ষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে ভূগর্ভের পানি তোলায় তলদেশে পানির স্তর ক্রমশ অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতে সুপেয় পানির সংকট হতে পারে। পানিতে লবণাক্ততা, আয়রনের আধিক্য, আর্সেনিক দূষণ, ভূমিধসসহ বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও হতে পারে।
পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের একটি নির্দেশিকা আছে। তাতে বলা আছে, পৌরসভা পানি সরবরাহ করলে পৌর পরিষদের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে পানি তোলা যাবে না। তবে নজরদারি না থাকায় গত এক দশকে যশোর পৌরসভার ১১ হাজার বাসাবাড়িতে সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে। পৌর শহরটির আয়তন ১৪ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার। এ প্রসঙ্গে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক কে এম দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘১৪ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটারের একটি শহরে ১১ হাজার সাবমারসিবল পাম্প পরিমাণে অনেক বেশি। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। এত পানি উত্তোলন করা হলে পানির স্তর স্থায়ীভাবে নিচে নেমে যেতে পারে। পুরোপুরিভাবে লবণাক্ততা চলে আসতে পারে। গোপালগঞ্জে এমনটি ঘটেছে।
এই অধ্যাপক বলেন, গোপালগঞ্জের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছের অস্তিত্ব আর মিলছে না। এভাবে সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে পানি তুললে শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি আরও বাড়া ছাড়াও ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
যশোর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে পানির গ্রাহক ১৫ হাজার। পৌরসভার পানি সরবরাহ শাখা সূত্র জানায়, প্রতিদিন পানির চাহিদা ২ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার লিটার। ওই পরিমাণ পানি উত্তোলনের জন্য ২৯টি পাম্প রয়েছে। চাহিদার বিপরীতে প্রতিদিন পানি তোলা হয় ২ কোটি ১১ লাখ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন ৩৩ লাখ লিটার পানির ঘাটতি থাকছে। শুষ্ক মৌসুমে ঘাটতি আরও বাড়ে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বিএডিসির যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যশোরে পানির স্তর নিচে নেমেছিল ৩১ ফুট। আর ২০২০ ও ২০২১ সালে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমেছিল ২৫ ফুট।
অভিযোগ রয়েছে, ঘাটতির কারণে পানি সরবরাহ হয় কম। দিনের মধ্যে কয়েক দফা পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর মধ্যে যেটুকু সময় পানি সরবরাহ হয়; তার বেশির ভাগ বহুতল ভবনের মালিকেরা মোটরের মাধ্যমে টেনে নিয়ে ট্যাংকে ‘রিজার্ভ’ করেন। শহরের চাঁচড়া রায়পাড়ার বাসিন্দা হেলেনা পারভীন বলেন, ‘বাসাবাড়ির লাইনে ঠিকমতো পানি আসছে না। আবার পানি এলেও গতি অনেক ধীর। কল দিয়ে চুইয়ে পানি পড়ে। বিল দিয়েও পানি পাচ্ছি না। পাম্প বসিয়ে অন্যরা আমাদের পানিতে ভাগ বসাচ্ছে। এতে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’
নিয়মবহির্ভূতভাবে সাবমারসিবল পাম্প বসানো বন্ধ এবং এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন; এমন প্রশ্নে যশোর পৌরসভার পানি ও পয়োনিষ্কাশন শাখার সহকারী প্রকৌশলী বি এম কামাল আহমেদ বলেন, পানির মান ও চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সাবমারসিবল বসানো এবং সেটি দিয়ে পানি তোলা বন্ধ করা কঠিন। পানি শোধনের জন্য পৌরসভার তিনটি প্ল্যান্ট আছে। সিটি কলেজ পাড়া, রেলগেট তেঁতুলতলায় ও পালবাড়ি এলাকায় পৌরসভার পাম্পে এই ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু এসব প্ল্যান্টে পানি শোধন করে সরবরাহ করাটা অনেক ব্যয়বহুল। শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হলে পানির যে পরিমাণ বিল ধার্য করতে হবে; সেটি অনেকে দিতে সমর্থ হবেন না।