বগুড়া জেলা কারাগারের কনডেম সেলের ছাদ ফুটো করে পালানোর পর আটক হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার কয়েদি। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে বগুড়া জেলা কারাগারের একতলা ভবনের কনডেম সেলের ২ নং ওয়ার্ড থেকে তাঁরা পালিয়ে যান।
এই চার কয়েদির মধ্যে মো. জাকারিয়া (৩৪) বগুড়ার কাহালু পৌরসভার মেয়র আবদুল মান্নানের ছেলে। তিনি উলট্ট গ্রামের বাসিন্দা। এক স্কুলছাত্রকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও হত্যার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকিরা হলেন, কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী থানার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু ওরফে মঞ্জু(৬০), নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ফজরকান্দি গ্রামের মৃত ইসরাফিলের ছেলে আমির হামজা ওরফে আমির হোসেন (৪১) এবং বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ি গ্রামের ইসরাইল শেখের ছেলে ফরিদ শেখ (৩০)।
জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আজ দুপুরে ঢাকা থেকে বগুড়ায় পৌঁছান অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান। তিনি বগুড়া জেলা কারাগার পরিদর্শন শেষে বলেন, বগুড়ার কারাগারটি অনেক পুরোনো, ১৮৩৩ সালে নির্মিত। ফলে ছাদ ছিদ্র করে তারা বেরিয়ে যায়। পুরো ঘটনাটি তদন্ত করা হবে। কীভাবে তারা সবার নজর ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেল। কার কী দায় ছিল সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, কারাগার থেকে আসামিদের পালিয়ে যাওয়ার কারণে এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি চিহ্নিত হয়েছে। এখন তদন্ত করে দেখতে হবে দুর্বলতা কোথায় ছিল? তারা পালিয়ে যাওয়ার সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেটিকে তদন্তের কাজে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
যেভাবে আটক হলেন চার কয়েদি
বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার আবু সাঈদ দুখু জানান, তিনি ঢাকা থেকে ফিরে রাত আড়াইটায় চেলোপাড়া পৌঁছান। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে তিনিসহ চার বন্ধু চেলোপাড়া করতোয়া নদীতে বাঁশের ব্রিজে বসে ছিলেন। রাত সাড়ে ৩টার পর নদীতে নির্মাণাধীন ব্রিজের কাছে অনেকগুলো কুকুর ঘেউ ঘেউ শুরু করে। তাঁরা সেখানে এগিয়ে গেলে দেখতে পান চারজন মানুষ নদীর হাঁটু পানিতে হামাগুড়ি দিয়ে তীরে ওঠার চেষ্টা করছেন। তাঁদের প্রত্যেকে সঙ্গে একটি করে ব্যাগ রয়েছে। চোর সন্দেহে চারজনকেই নদী থেকে তুলে এনে পাশের চাষী বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। চারজন নিজেদের রাজমিস্ত্রি পরিচয় দিয়ে বলেন, বেজোড়া এলাকায় ঠিকাদার তাঁদের মারপিট করে নদীতে ফেলে দিয়েছেন। তাঁরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে এসেছেন।
তাঁদের অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং একজনের পরনে কয়েদির পায়জামা থাকায় সন্দেহ হয়। তাঁদের ব্যাগ তল্লাশি করে নগদ ৯ হাজার টাকা, ৭০ প্যাকেট সিগারেট, একটি স্টিলের পাত, একটি স্ক্রু ড্রাইভার এবং কয়েদির কাগজ পাওয়া যায়। একপর্যায়ে তাঁরা নিজেদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং জেলখানা থেকে পালানোর কথা স্বীকার করেন।
আবু সাঈদ দুখু মিয়া আরও বলেন, রাজনৈতিক মামলায় আমি অসংখ্যবার জেলখানায় ছিলাম, সেখান থেকে পালানোর গুরুত্ব আমি বুঝতে পারি। এ কারণে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিল পরিমল চন্দ্র দাসকে জানাই।
পৌর কাউন্সিলর পরিমল বলেন, দুখুর মাধ্যমে খবর পেয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানাই এবং আমি নিজে ঘটনাস্থলে যাই। এ সময় একজন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ এবং আমাদের লোকজন ধাওয়া করে তাঁকে আটক করে।
একমাস ধরে চলে খোঁড়াখুঁড়ি
আবু সাঈদ দুখু জানান, আটকের পর তাঁদের ব্যাগে একটি স্ক্রু ড্রাইভার ও স্টিলের পাত পাওয়া যায়। তাঁরা জানান, একমাস আগে তাঁরা একতলা ভবনের ছাদের এক কোনায় ফুটো করার পরিকল্পনা করেন। সেই অনুযায়ী স্ক্রু ড্রাইভার ও বালতির হাতল মেঝেতে ঘষে চোখা করেন। জাফলং নামের ভবনটির ছাদ অনেক পুরোনো চুন সুরকি ও মাটির টালি দিয়ে তৈরি। তাঁরা একমাস ধরে প্রতি রাতে একজনের ঘাড়ে আরেকজন চড়ে ছাদ ফুটো করতে শুরু করেন। গত শনিবার রাত ২টার পর থেকে সেই ফুটো দিয়ে কাপড় চোপড়সহ নিজেরা বের হওয়া শুরু করে। পরিধেয় বস্ত্র এবং বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে রশি বানিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে জেলখানা সংলগ্ন করতোয়া নদীতে নামেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকজন সন্দেহ করবে এ কারণে তাঁরা নদী দিয়ে যেতে থাকেন।
দুখু বলেন, পলাতক চারজনের মধ্যে ফরিদ শেখের আত্মীয় বাড়ি চেলোপাড়ার পাশের নারুলীতে। তাঁরা সেখানে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশে চেলোপাড়া ব্রিজের কাছে নদী থেকে তীরে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ শুরু করলে আমরা চোর সন্দেহে নদী থেকে চারজনকে আটক করি।
এদিকে জেলাখানা থেকে পালানোর পর গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের নামে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেছেন বগুড়া জেলা কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল।