জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
সে এক দারুণ মজার ঘটনা ঘটল সেদিন আসাদ গেটের আড়ং-এর সামনের লাল-হলুদ-সবুজ বাতির কাছে। বরাবরের মতো অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে আছে গাড়ি। এই সুযোগ নিয়ে এক বাচ্চা এল ব্রাশ হাতে। নাগাল পায় না, তারপরও চেষ্টা করতে থাকল গাড়ির কাচের কাছে পৌঁছতে। নাগাল কি আর পায়?
গাড়ি যেহেতু নড়ে না, চড়ে না, তাই ওর সঙ্গে একটু কথা বলার অবকাশ হয়। কাজ না করেও কাজের একটা ভালো মজুরি লাভ করায় ওর মুখে তখন হাসি ফুটেছে। ওর বয়সটা আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। তবে তিন বা চার হবে বলে সন্দেহ হয়। শুরুতেই প্রশ্ন জাগে মনে, এই নিত্য কোলাহলের মধ্যে ধাবমান যন্ত্রযানের ভেতর কী করে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে!
তাই শুরু হয় কথোপকথন।
‘মা কই?’
আধো গলায় উত্তর আসে, ‘ওইখানে বইয়া রইসে।’
তারপর হাতে জমানো টাকাগুলো একবার এই হাতে নেয়, আবার ওই হাতে নেয়। তারপর গোনার ভান করে।
‘টাকাগুলা লুকায় রাখো। নাইলে তো কেউ নিয়া নিব।’
কথাগুলো শোনে মেয়েটা। কিন্তু ওভাবেই টাকা গোনার ভান করতে থাকে।
বলি, ‘তুমি বইসা থাকবার পারো না?’
নির্দ্বিধায় উত্তর দেয়, ‘বাসায় ট্যাকা লাগব।’
‘টাকা লাগব ক্যান?’
‘ঘরভাড়া দিতে হইব।’
‘ঘর ভাড়া কত?’
‘চল্লিশ টাকা।’
এইবার ওর চেহারার মধ্যে বয়সটা ফুটে ওঠে। যে এই আমলেও ঘরভাড়া চল্লিশ টাকা বলতে পারে, সে যে অঙ্কে তুখোড় মাস্টার, সে কথা বলে দিতে হয় না।’
‘খাইতে হইব না? কী খাইবা আইজ রাইতে?’
‘মোয়া খামু।’
‘ভাত খাইবা না?’
‘খামু। ডিম দিয়া। মায় রানছে।’
‘তোমরা কয় ভাই-বোন?’
‘চাইর বইন।’
‘আর বইনেরা কই?’
‘হ্যারা চকলেট বেচে।’
এ সময় একবার সবুজ সংকেতে গাড়ি এগিয়ে যায় খানিকটা। এবং এসে দাঁড়ায় ওর মায়ের সামনে। মায়ের কোলঘেঁষে দাঁড়ায় মেয়েটা। আমি বেশ সবজান্তার মতো বলি, ‘আপনার আর তিন মেয়ে কোথায়?’
মা আকাশ থেকে পড়েন, ‘আমার তো এই একটাই!’
‘ও তো বলল ওরা চার বোন! আজ কি ডিম রান্না করে এসেছেন?’
মা হাসেন। ‘আমরা প্রত্যেক দিন ডিম আর ভাত হোটেল থিকা কিইন্যা খাই।’
‘ঘরভাড়া কি চল্লিশ টাকা?’
‘কী কন! ঘর ভাড়া পনেরো শো টাকা।’
এবার বলি, ‘আপনি নিজে কাজ না কইরা এইটুকু একটা বাচ্চারে রাস্তায় নামাইছেন ক্যান?’
মা বলে, ‘বাড়িতে ছুটা কাম করলে আমার ইনকাম যত, ওর ইনকাম তার থিকা বেশি!’
এ সময় আবার সবুজ সংকেত। দ্রুত জিজ্ঞেস করি, ‘বাচ্চাটার নাম কী?’
গাড়ি ততক্ষণে এগিয়ে গেছে বেশ খানিকটা। আকলিমা না আসমা, কী উত্তর দেন ওর মা, সেটা বোঝা আর হয় না। গাড়ি ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেকটা।