রিফাত মেহেদী, সাভার (ঢাকা)
বাবার বয়স প্রায় ৮০ বছর। প্রায় ১৩ বছর আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে মা মারা গেছেন প্রায় ৯ বছর আগে। অসুস্থ বাবাকে দেখভাল করার দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন ছেলে মাসুদ। সাত ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ তৃতীয়। বাকি সবাই নানা কাজে জড়িয়ে পড়লেও মাসুদ বাবার পাশে থাকার টানে কর্মহীন থেকে যান। বয়স ৪৮ পেরিয়ে গেলেও বিয়ে করা হয়নি তাঁর। বিয়ের জন্য বাবা অনেকবার জোরাজুরি করলেও করেননি মাসুদ। বাবার প্রতি ভালোবাসাকে ঘিরেই তাঁর হাজারো গল্প। বাবাকে নিয়েই তার সব ব্যস্ততা। বাবা দিবসে আজ থাকছে সেই বাবা-ছেলের গল্প।
আমজাদ আলী খন্দকার। ২০০৪ সালে চাকরিজীবন শেষ করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের চিফ ক্যামেরাম্যান হিসেবে। বিটিভিতে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ডের রিল নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন সেটি রক্ষা করতে। ২০২২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটা। সাভারের মধ্য গেন্ডা এলাকায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আমজাদ আলী খন্দকার ঘুমোচ্ছেন। একটু পরেই আসরের আজান দিলে বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন ছেলে মাসুদ। বাবাকে অজু করিয়ে দিয়ে সঙ্গে নিয়ে নামাজ আদায় করেন। পরে জামাকাপড় পরিয়ে দিয়ে বাবাকে নিয়ে আসেন বাড়ির উঠানে।
জানা যায়, প্রায় ১৩ বছর আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন আমজাদ আলী খন্দকার। এর চার বছর পর স্ত্রীকে হারান। ছয় ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তৃতীয় ছেলে মাসুদ বাবার সঙ্গেই থাকছেন। বাকিরা সবাই নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত। সবাই যে যার মতো চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। মাসুদ ব্যবসা করতেন। মাসুদের দাদিও শতবর্ষী। বাবা, বড় ভাই আর দাদির পেছনে সময় দিতে গিয়ে নিজের ব্যবসাকে আর এগিয়ে নিতে পারেননি মাসুদ।
বিয়ে কেন করা হয়নি জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘পারিপার্শ্বিক নানা কারণেই বিয়ে করা আর হয়ে ওঠেনি। আমি আমার বাবাকে যেভাবে দেখেশুনে রাখতে পারছি, অন্য বাড়ির এক মেয়ে আসলে কি বাবাকে এমনভাবে দেখেশুনে রাখতে পারব? বিয়ের পর বউ এসেও তো একটু আলাদা সময় চাইবে, তখন তো তাঁকেও সময় দিতে পারব না, বাবাকেও সময় দিতে পারব না। আমি যদি বিয়ে করে অন্য ভাইদের মতো বাইরে যাই, তাহলে বাবাকে দেখবে কে?’
বাবা আমজাদ আলী ও ছেলে মাসুদের মধ্যে সম্পর্ক এখন বাবা-ছেলের চেয়েও বেশি কিছু। ছেলে কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়াল হলে বাবা অধৈর্য হয়ে পড়েন। ছেলেও বাবার চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়েন। বাবার জন্য এক দিনের জন্য বাড়ির বাইরে রাত কাটান না মাসুদ।
কথা হলে মাসুদ বলেন, ‘আমি যদি বাজারে পাঁচ মিনিট দেরি করি, তাহলে বাবা ফোন দিতেই থাকেন। আমারও বাবার জন্য চিন্তা হয়।’
কথা হয় আমজাদ আলী খন্দকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আমার ছেলেই সব। আমি যদি ঘর ভরে পায়খানাও করে দিই, আমার ছেলেই সব পরিষ্কার করে। অনেক সময় জামাকাপড় সব নষ্ট হয়ে যায়, আমার ছেলেই সব পরিষ্কার করে। আমার বাবাও স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী ছিলেন। আমি আমার বাবাকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে কারণেই হয়তো আমার ছেলে আমাকে সেবা করছেন। আল্লাহ সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। মাসুদ না থাকলে এখন যেমন আছি হয়তো তেমন থাকতে পারতাম না। এমনভাবে চলতে পারতাম না।’
একুশে পদক নিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ‘আমি কাজ করেছি, কাজের স্বীকৃতি চেয়েছিলাম। একুশে পদক পাব, তা তো ভাবিনি। একুশে পদক পাওয়ার পরও জীবন আগের মতোই আছে। পদক পেয়েছি, এতে গর্বিত।’