Ajker Patrika
হোম > ছাপা সংস্করণ

বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কার কাছে কত: রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ১০ হাজারের বেশি

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা

বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কার কাছে কত: রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ১০ হাজারের বেশি

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর অস্ত্র হাতে গত মে মাসে মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র হলেও পুলিশের উপস্থিতিতে এভাবে প্রকাশ্যে প্রদর্শন ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, বিপদে ব্যবহারের জন্যই অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন। এখানে ভুলের কিছু নেই।

সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে রয়েছে ১০ হাজারের বেশি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র। লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের তিন-চতুর্থাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। সংখ্যায় এর পরেই আছেন বিএনপির নেতারা। স্থানীয় সরকারের আওয়ামী লীগদলীয় জনপ্রতিনিধি, দলের মহানগর, জেলা, উপজেলা, থানা পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি কিছু কর্মীও রাজনৈতিক পরিচয়ে আবেদন করে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে থাকা লাইসেন্সের বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে গত ১৪ বছরে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন দলটি ক্ষমতায় থাকাকালে।

বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের হিসাব রাখা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ছাত্র-শ্রম বিভাগের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এসবি ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফএএমএস) মাধ্যমে এসব অস্ত্রের হিসাব রাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেওয়ায় কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। রাজনৈতিক পরিচয় থাকায় আবেদন মঞ্জুরের আগে গোয়েন্দা তদন্তও হয় দায়সারা। এভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ যে বিপথগামী হন, এমন নজিরও আছে। মাঝে মাঝে শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের ঘটনা হাতে গোনা।

‘আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬-এর ৩২ (ঞ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদিত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য বিশেষ প্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এঁদের লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত আয়কর পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সুযোগই নিচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের নেতারা।

পুলিশের বিশেষ শাখার সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্র বলছে, ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ও আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৫০ হাজার ৩১০ টি। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে ৪৫ হাজার ২২৬ টি। এগুলোর মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিকদের নামে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের হাতে রয়েছে ৭ হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাতে ২ হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে মাত্র ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯ টি, পিস্তল ৪ হাজার ৬৮৩ টি, শটগান ৫ হাজার ৪৪৪ টি। বাকিগুলো দোনলা বন্দুক, রিভলবার ও রাইফেল। বিভাগভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১৪ হাজার ৬৮৩ টি। সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে, ২ হাজার ১১৮ টি।

ঢাকার বাইরের একটি মহানগরে সিটি এসবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী পরিচয় এবং কাগজপত্র একটু ঠিক থাকলে লাইসেন্স আটকানো হয় না।

ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুষ্টিয়া, বগুড়াসহ কয়েকটি জেলার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতারাও আবেদন করে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। তালিকায় দেখা যায়, রাজধানীর হাতিরঝিল-রমনা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল কবির লাইসেন্স পেয়ে একটি অত্যাধুনিক উজি পিস্তল কিনেছেন। মিলিটারি গ্রেডের এই অস্ত্র সাধারণ মানুষের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাঁর অস্ত্রের ক্রমিক নম্বর ডব্লিউআই-০০৬৯৮০। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার জন্য লাইসেন্স নিয়েছি। পছন্দ হওয়ায় উজি পিস্তল কিনেছি।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও বর্তমানে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসেন তিতু আট বছর আগে লাইসেন্স পেয়ে অস্ত্র কিনেছেন। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুনু মিয়ারও কয়েক বছর ধরে লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে। তিনি বলেন, নিজের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র নিয়েছেন, তবে ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি।

বগুড়ার সান্তাহারের আওয়ামী লীগের কর্মী মাহমুদুর রহমান পিন্টুও লাইসেন্স পেয়ে একটি শটগান কিনেছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন আগে শটগানটি কিনলেও কখনো ফায়ার করেননি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর (লালখান বাজার) ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসানাত মো. বেলালের কাছে লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ২০০৯ সালে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তার জন্য বৈধ অস্ত্র সঙ্গে রাখেন।

সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোখলেছুর রহমান কামরানের দুটি বৈধ অস্ত্র আছে। তাঁর দাবি, এ দুটি অস্ত্রে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।

লাইসেন্স পেয়ে অত্যাধুনিক পিস্তল কিনেছেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সেলিম হাসান, নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা জাহিদুর ইসলাম সুজন। সুজন বলেন, ‘রাজনীতি করি। সঙ্গে একটা পিস্তল রাখতে হয়, তাই নিয়েছি।’

ওয়ার্ড-থানা পর্যায়ের রাজনীতিকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেন না সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব কামাল উদ্দিন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য নন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা কাউকে ধরে লাইসেন্স নিয়েছেন। এমন ব্যক্তিরা বিপজ্জনক। যাঁরা লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ যে বিপথগামী হবেন না, তা কিন্তু নয়। এমন নজিরও কম নেই। 

শর্ত লঙ্ঘন করলেও লাইসেন্স বাতিল হয় না
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা, ২০১৬-এর ২৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিজ লাইসেন্স করা অস্ত্র আত্মরক্ষার নিমিত্তে নিজে বহন অথবা ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অন্যের ভীতি/বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে, এরূপভাবে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে বিধিমালা ভঙ্গের কারণে লাইসেন্স বাতিলযোগ্য হবে। তবে মাঝে মাঝেই প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনা ঘটলেও লাইসেন্স বাতিলের সংখ্যা হাতে গোনা।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাহার আলীর বিরুদ্ধে বৈধ অস্ত্র নিয়ে নিয়মিত এলাকার মানুষ ও প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। চলতি মাসেই দিনদুপুরে অস্ত্র নিয়ে হুমকি, প্রতিপক্ষকে ধাওয়া এবং রাস্তায় অস্ত্র প্রদর্শনের একাধিক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে অভিযোগও করেছেন। আতাহার আলীর দাবি, জীবন ও অস্ত্র রক্ষার্থেই তিনি বারবার পিস্তল প্রদর্শন করেছেন।

তবে মিরপুর থানা-পুলিশ তদন্ত শেষে দুই পক্ষের ওপরই দায় চাপিয়েছে।

গত জুলাইয়ে ফরিদপুর জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপকমিটির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সদস্য ডা. গোলাম কবিরের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে এক ভাড়াটেকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ওঠে। তবে এ নিয়ে কোনো কথা বলেনি ফরিদপুর জেলা পুলিশ।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এনামুল হক সাগর বলেন, বৈধ অস্ত্র নিয়ে মাস্তানি করার সুযোগ নেই। অভিযোগ এলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ তদন্ত করে লাইসেন্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুপারিশ করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নীতিমালা ভঙ্গ করায় সারা দেশে ২৭টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ী বাতিল হয়েছে। 
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেওয়ায় কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। যাঁরা প্রকৃত রাজনীতি করেন, বিশেষ কয়েকজন ছাড়া অন্য কারও অস্ত্রের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। বৈধ অস্ত্র কেউ কেউ অহেতুক প্রদর্শন করছেন, আবার কেউ প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখাতে ব্যবহার করছেন।

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ

ঢাকা সড়ক পরিবহন: প্রশ্নবিদ্ধ কমিটিতেই চলছে মালিক সমিতির কার্যক্রম

৪০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করবে টিসিবি

৮ বছরে শিশুহত্যা হয়েছে ৪০০০

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির শীর্ষে বাংলাদেশ, তবে বাজারে পিছিয়ে

দেশে ব্যবসায় ঘুষ–দুর্নীতিসহ ১৭ রকমের বাধা

বিদ্যালয়ের জমিতে ৩৯১টি দোকান, ভাড়া নেয় কলেজ