পৌষ এই এল বলে! এখন সময় রোদে পিঠ পেতে দিয়ে গরম-গরম খাবার খাওয়ার। ধোঁয়া ওঠা সাদা ফ্যানভাতের ওপর হলুদ বরণ একটুখানি গাওয়া ঘি, সঙ্গে টেলে নেওয়া কাঁচা মরিচ, একটুখানি আলুভাজি। আর সঙ্গে যদি থাকে আগের রাতে রান্না করা বড় পুঁটিমাছের সরপড়া ঝোল, তাহলে স্বর্গ ধরা দেবে জিভের ডগায়। সেই কবে আমাদের কোন পূর্বপুরুষ বলে গেছেন, গরম ভাতে গাওয়া ঘি দিয়ে যে লোক ভাত খায়, সে ভাগ্যবান।
কিন্তু মর্ত্যের মানুষ শীতের দিনে গরম-গরম ভাত খেতে পারলেই বর্তে যায়। ভাতই কেন? কারণ এই পুণ্যভূমি বদ্বীপে হাজার বছর ধরে শস্য হিসেবে প্রধান হচ্ছে ধান। ধান থেকে চাল আর চাল সেদ্ধ করে ভাত খাওয়ার রীতি গড়ে উঠেছে প্রাচীন কাল থেকে। ধানের প্রাধান্য এমনই যে হেমন্ত ঋতুতে উৎপাদিত সব ফসলের নাম হৈমন্তী হলেও এই বঙ্গে হেমন্ত হয়ে গেছে ধানের ঋতু। আর উদরপূর্তি করা সব খাবারের আভিধানিক নাম ‘অন্ন’ হলেও এখানে ভাতের নাম অন্ন। ভাতের শক্তি এখানে এমনই প্রবল যে এ দেশের এক ঐতিহাসিক পুরুষ তর্জনী উঁচিয়ে বলতে পারেন, ‘তোমাদের ভাতে মারব।’
ফলে এখানে, এই অনায়াসে উৎপন্ন হওয়া ধানের দেশে ভাতকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবনচর্যার প্রজন্মান্তরের জ্ঞান তৈরি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিকে শত শত বছর ধরে সজীব রাখার কারিগর নারীরা। কোনো পুরস্কারের তোয়াক্কা না করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন খাদ্যসংস্কৃতির বিশাল জগৎকে। বছরের পর বছর হেঁশেলে আগুন-পানি-চাল-ডাল-মাছ-মাংস আর মসলাপূর্ণ জীবনে খাদ্যসংস্কৃতির যে প্রজ্ঞা নারীরা অর্জন করেছেন, তাতে জীবনের বিপুল বয়ান ধরা পড়ে। সেই প্রজ্ঞার সূত্র ধরেই তাঁরা নির্মাণ করেছেন খাদ্যবিজ্ঞান। সেখানেই আমরা পাই শীতের দিনের গরম ভাত খাওয়ার বিজ্ঞান, প্রবাদের মোড়কে।
একবার শুধু ভেবে দেখুন, দুধসাদা ভাতের ওপর ছাঁকা তেলে ভেজে তোলা কড়কড়ে মাছ কিংবা আলুভাজি অথবা বেসনে ডোবানো বকফুল বা কুমড়ো ফুলের বড়া আপনার সামনে। এই শীতে আর কিছু কি দরকার আছে কোনো বিশুদ্ধ বাঙালির? কিংবা জুঁই ফুলের মতো সাদা সুগন্ধি চালের ভাতের ওপর হালকা গরম মাংসের ঘন খয়েরি ঝোল আর হলুদ আলুর রসায়ন? ভেবে দেখুন তো?
ভাজি বা ভাজা নিয়ে এত কথা যখন হচ্ছে, চলুন, আজ শুক্রবারের এই ছুটির দিনে একটি ভাজির রেসিপি দিই আপনাদের। আমি নিশ্চিত, বেশির ভাগ মানুষ এর কথা শোনেননি। এই খাবারের নাম ‘তিলের পাট ভাজি’। প্রথমে তিলের খোসা ছাড়িয়ে নিন। অবশ্য এখন পরিষ্কার তিল কিনতেই পাওয়া যায়। দুই ভাগ তিল ও এক ভাগ চাল, পরিমাণ হবে এটি। পরিষ্কার তিল ভেজানো আতপ চালের সঙ্গে পাটায় বেটে নিন। আবার তিল বেটে নিয়ে আতপ চালের গুঁড়ো পরে মিশিয়েও নেওয়া যায়। এর সঙ্গে স্বাদমতো মরিচবাটা ও লবণ মিশিয়ে নিন। এবার সবকিছু ভালো করে ঘুঁটে নিয়ে ব্যাটার তৈরি করুন। সেই ব্যাটারে শসা, ছাঁচি কুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন এ রকম সবজি পাট পাট করে কেটে ডুবিয়ে নিন। তারপর ডুবো তেলে ভেজে নিন। আজ থেকে বহু বছর আগে কিরণ লেখা রায় বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে এ রেসিপি সংগ্রহ করেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী শরৎকুমার রায় ১৯২০ সালের দিকে ‘বরেন্দ্র রন্ধন’ নামে সংকলনে প্রকাশ করেছিলেন।