সেবার গিয়েছিলাম কুলাউড়ায়। নির্জন এক রেস্টহাউসে পৌঁছে যখন দুপুরের খাবার পাতে, তখন ছোট্ট এক টুকরো আইড় মাছ মুখে পুরেই চমকে উঠলাম। ঢাকা শহরে কাটিয়ে দেওয়া অর্ধশতাব্দীতে এই স্বাদের আইড় মাছ খাইনি কখনো। যাঁরা এক মাইক্রোবাসে করে এখানে এসেছেন, তাঁদের প্রায় সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। একজন ছাড়া। বাড়ি তাঁর কাছে-ধারেই। মাছের স্বাদ যে এ রকমই, সেটা তিনি জানেন। মাছের স্বাদ যে এ রকম, সেটা বাকি আমরা জানতাম না।
হাওরপারের মানুষদের কেউ কেউ বহুবার বলেছিল, ‘একবার আসুন আমাদের দেশে। দেখবেন মাছ কাকে বলে।’
মাছের লোভ দেখানোকে নিছক এলাকায় নিয়ে যাওয়ার চালাকি ভেবেছিলাম। কিন্তু সত্যিই যখন আইড় মাছটাকে মনে হলো অমৃত, তখনই কেবল উপলব্ধিতে এল, প্রাকৃতিক সম্পদকে নষ্ট করার দায় শহর এড়াতে পারে না।
এরপর রুই, এরপর বনমোরগ, এরপর পুঁটি। আমরা বুঝলাম, জিহ্বাকে রসনা কেন বলা হয়। রসনা তৃপ্ত হয় কিসে, সেটা আমাদের শেখাল কুলাউড়া। আর তখনই আমাদের ইচ্ছা হলো, কাজের শেষে একবার যেতে হবে হাওরে। হাকালুকি হাওর কাছেই। মাইক্রোবাসে করে জুড়ীতে গিয়ে ভাড়া করতে হয় একটা ইঞ্জিন-নৌকা। তারপর সমুদ্রের মতন হাওর এসে দাঁড়ায় চোখের সামনে।
হাওরের গল্প আজ নয়। আজ হবে আবদুল করিমের গল্প। আমরা যে ঘাটে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেখানে বেশ কয়েকটা দোকান ছিল। রেস্তোরাঁ, মনিহারি দোকান, এমনকি জামাকাপড়ের দোকানও আছে সেখানে। আর অদূরে বসে ছিলেন আবদুল করিম। একমনে বুনছিলেন জাল।
‘চাচা, এখানে কখন আসেন?’
‘সকালে আসি। আমি মাছ বিক্রি করি।’ তাঁকে জেলে বলে যেন সন্দেহ না করি, সেটা নিশ্চিত করার জন্য তিনি নিজের কাজের বিবরণ দেন।
একটু সামনেই যে ড্রামটা আছে, সেখানে দেখা গেল মাছের নড়াচড়া।
‘কোত্থেকে মাছ আনেন?’
‘আড়ত তাইখা (থেকে)।’
‘আড়ত কোথায়?’
‘ওই তো এই দিকে’ বলে সামনের দিকে ডান হাত প্রসারিত করে দেন। সেটা ঠিক বুঝতে দেয় না আড়তের দূরত্ব।
‘আপনার মাছ কেনে কারা?’
‘গেরামোর মাইনশেই খিনে।’
‘গ্রামের লোকজন আড়তে গিয়ে কিনতে পারে না?’
‘আড়ত তিখা নেয়। আমার তিখাও (থেকেও) নেয়।’
‘কী মাছ বিক্রি করেন?’
‘এখন পাঙাশ আছে। সিলভার কাপ (কার্প), চিংড়িও বিক্রি করি।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘পরিবার আর তিন মেয়ে। দুইটার বিয়া হইসে। এখটা আমাদের সাতে তাখে (থাকে)।’
‘বাড়ি কোথায়? বাড়ি যান কখন?’
‘বাড়ি যাইতে রাত আটটা বাইজা যায়।’
‘আপনার বয়স কত?’
‘আমার বয়স বর্তমানে বাষট্টি। আসলে বয়স আরও বেশি।’
‘কত বয়স?’
‘ষাইট ওইব।’
এই জটিল অঙ্ক বোঝা হয়ে ওঠে না।
‘কেমন আছেন আপনি?’
‘বালা। দিন তো খাটে (কাটে), দিন তো খাটে না।’
এই দার্শনিক কথার মানে বের করা কঠিন। এরই মধ্যে ভাড়া করা বড় নৌকাটায় উঠতে শুরু করেছেন আমাদের দলের লোকেরা। আমরা নিশ্চিত, হাওরে ভাসতে ভাসতে সূর্যাস্ত দেখা যাবে। সে রোমাঞ্চ যখন আমাদের ঘিরে ধরে, তখন হঠাৎ করে আবদুল করিমের চেহারাটা ভেসে ওঠে মনে। রাত ৮টা পর্যন্ত এই ঘাটেই কেটে যাবে তাঁর আরও একটি নিরানন্দ দিন। তারপর আরও একটি, আরও একটি…