সেই অশ্বত্থগাছটিই পরে মুখে মুখে বটগাছ হয়ে গেছে
—সৈয়দ হাসান ইমাম
আমাদের শৈশবে এটা ব্যবসায়িকদের অনুষ্ঠান ছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো না, হালখাতা হতো। সারা বছরের বাকি কিংবা খরচপাতি হালখাতার দিনে শোধ করতে হতো। লাল একটা খাতা ছিল, সেখানে সব লেখা থাকত। সেদিন স্কুল খোলা থাকত। আমরা স্কুল থেকে হয়তো সেসব দোকান ঘুরে আসতাম। নতুন কাপড় পরতাম নতুন বছরে। গ্রামের দিকে মেলা তখনো হতো। সেটা একেবারেই গ্রামকেন্দ্রিক।
এখন আর ভোরবেলায় মিছিলে যোগ দিতে পারি না। ইচ্ছে করে কিন্তু শারীরিক সক্ষমতা নেই। ওখানে এখনো গিয়ে কবিতা পড়ি। কিন্তু ভোরবেলার মিছিলে যেতে পারি না। ড. নওয়াজেশ আহমেদের পরামর্শে অশ্বত্থগাছের নিচে আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম প্রথম। সেই অশ্বত্থগাছটিই পরে মুখে মুখে বটগাছ হয়ে গেছে।
আমাদের ছাত্রজীবনে পয়লা বৈশাখ এত আড়ম্বরভাবে পালন হতো না
—
আমাদের ছাত্রজীবনে পয়লা বৈশাখ এত আড়ম্বরভাবে পালন হতো না। তবে নতুন বছর যে শুরু হচ্ছে, এই ব্যাপারটা ছিল তখনো। নতুন জামাকাপড় পরতাম। কিন্তু নতুন জামাকাপড় যে দরকারই হবে, এমনটা ছিল না। বাড়িতে ভালো রান্না হতো। মিষ্টি-পায়েস রান্না হতো। সেগুলো খাওয়াদাওয়া হতো। দিনটা ভালোভাবে কাটানোর চেষ্টা করতাম। এমন একটা বিশ্বাস ছিল যে বছরের প্রথম দিনটা ভালো গেলে সারা বছর ভালো যাবে। এখন যেমন এটা বিরাট আনন্দ, ঘুরতে যাওয়া, ধুমধাম, নতুন কাপড় পরা, লাল-সবুজ—আমাদের শৈশবে এত সব ছিল না। আমরা স্কুল-কলেজে এটা আলাদা করে কখনো পাইনি। তবে মেলা হতো তখনো। মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যেত। আমরা যেতাম আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে। পাকিস্তান আমলে বৈশাখটা ওভাবে পালন করা সম্ভব হতো না। মানে স্কুল-কলেজ বন্ধ দেওয়া হতো না।
আমি যে এলাকায় এখন থাকি, সেখানে আফসানা মিমির ‘ইচ্ছেঘুড়ি’ নামের একটা স্কুল আছে। কয়েক বছর ধরে ওই স্কুলটাতে যাই। বাচ্চারা রঙিন পাখি, খেলনা নিয়ে একসঙ্গে বের হয়। ওদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিই। এবারও ওরা দাওয়াত দিয়েছে। যাব ভাবছি। তবে এই দিনটাতে আমার মেয়েদের খুব মিস করি। ওরা দেশের বাইরে থাকে।
—সাবিনা ইয়াসমীন
আমার পয়লা বৈশাখের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না। কারণ ওই বয়সটায় আমি পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের জন্য বাইরে ছোটাছুটি করতে পারিনি। যে বয়সে আমার উৎসব-পার্বণ নিয়ে মেতে থাকার কথা, সেই বয়সেই আমি গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেই ব্যস্ততা আজও শেষ হয়নি। আমাদের উৎসব মানে যেন উদ্যাপন নয়, কেবলই গান গাওয়া। এখন তাও কিছুটা সময় পাই। সাধারণত পয়লা বৈশাখে বন্ধুরা আমার বাসায় আসে। সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি, গল্পগুজব করি। দিনটা নতুনভাবে, সুন্দরভাবে কাটানোর চেষ্টা করি।
—চঞ্চল চৌধুরী
আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে। আমাদের গ্রামে বৈশাখে হালখাতা হতো। বাড়ির পাশে যে বাজার ছিল, সেখানে। আমরা বাজারে বিভিন্ন দোকানে যেতাম। হালখাতার দিন বিভিন্ন দোকান থেকে জিলাপি, মিষ্টি, শিঙাড়া খেতে দিত। এটা এখন খুব মিস করি। আর ছিল চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। ওই মেলায়ও যাওয়া হতো। আমরা ছেলেরা মাটির ঘোড়া, টিনের পিস্তল, চরকি কিনতাম। আমাদের এলাকায় বলত ফেনী, বাতাসা-চিনির সাজ, গুড়ের সাজ—এমন বিভিন্ন ধরনের খাবার ছিল। খুব ভালো লাগত এসব খাবার। এখন তো বৈশাখের দিন ঢাকাতেই থাকি। বেশ কয়েক বছর ধরে টেলিহোমের আয়োজনে যে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়, সেখানে আমরা শিল্পীরা জড়ো হই। একটা মিলনমেলা হয় সেখানে।
আমি যেহেতু চারুকলার ছাত্র, তাই চারকলায় বর্ষবরণের যে প্রস্তুতি হয়, সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করি। একটা সময় তো শোভাযাত্রার আয়োজনের সঙ্গে থাকতাম রাতদিন। এখন ঢাকা শহরে এত জ্যাম যে ভোরবেলা উঠে পরিবার নিয়ে শোভাযাত্রায় যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। একটু বেলা হলে যাই। এবারও যাব ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলের জেনারেশনের তো বৈশাখ নিয়ে অত আগ্রহ নেই। সত্যি কথা বলতে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কতটুকু বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করবে, সেটা প্রশ্নের ব্যাপার। এসব নিয়ে আমাদের যে আবেগ ছিল, এখনকার দিনে সেটা নেই বললেই চলে।