ঘটনা ১
আমার সামনে ২৩-২৪ বছরের এক তরুণী চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ নিয়ে বসে আছেন। সঙ্গে তাঁর মা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার সমস্যা কী?’ তরুণী আরও সংকুচিত হয়ে গেলেন। তাঁর মা এবার বললেন, ‘দিন তিনেক আগে কথা-কাটাকাটিকালে মেয়েজামাই মেয়ের কানে থাপ্পড় মারছে। অহন কানে হুনে না।’ কান পরীক্ষা করে দেখলাম, বাঁ কানের পর্দা ফেটে গেছে। আমি বুঝে গেলাম কী হয়েছে। আমি যখন সব বুঝিয়ে বলছি, তখন তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়লেন। মা বলে উঠলেন, ‘স্যার, মাইয়ারে বিয়া দিছিলাম বছর দেড়েক আগে। কিন্তু জামাইটা বালা পড়ছে না, নেশা করে। যৌতুকের জন্য চাপ দেয়।’
জানলাম, মাস কয়েক আগে মেয়ের ভাই বিদেশে গেছেন (মধ্যপ্রাচ্যে)। নিজেরই ঠিকমতো রোজগার নেই। তার পরও বোনের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন, কিন্তু বোনজামাই সেই টাকা নেশায় উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন তাঁর আরও টাকা চাই। জিজ্ঞেস করলাম, ‘জামাই কী করে?’ ‘রাজমিস্ত্রির জোগালি, তা-ও প্রতিদিন কাজে যায় না।’
ঘটনা ২
সুটেড-বুটেড এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। স্ত্রীর মুখ থেকে মাথার চুল সবকিছুই হিজাবের আড়ালে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সমস্যা কী? স্ত্রীর ইতস্তত ভাব দেখে স্বামী ভদ্রলোক বললেন, ‘স্যার, গত রাতে ছোট বাচ্চা কানে লাথি মেরেছে। এখন কানে কিছু শোনে না, আর খুব ব্যথা।’ আমি ভদ্রমহিলাকে কান থেকে হিজাব সরিয়ে বসতে বললাম পরীক্ষা করার জন্য। ভদ্রলোকের ঘোরতর আপত্তি। পর্দা সরানো যাবে না। বললাম, ‘তাহলে তো কান ঠিকমতো দেখা যাবে না।’ স্বামী বললেন, ‘আপনি যতটুকু দেখেন, তাই দেখে ওষুধ লিখে দেন। একটা বাচ্চার আঘাত আর কতটুকু।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘যে বাচ্চা আঘাত করেছে, তার বয়স কত?’ স্বামী বললেন, ‘দুই বছরের কম।’ এতক্ষণে রোগী কান থেকে কাপড় সরিয়ে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আপনি দেখেন।’
পরীক্ষা করে দেখি, কানের পর্দা ফেটে ভেতরে রক্ত জমে আছে। বললাম, ‘আপনার বাচ্চার যে বয়স বললেন, তার তো এত মারাত্মক আঘাত করার শক্তি নেই।’ তখন স্ত্রী বলে উঠলেন, ‘আসলে বাচ্চা না, বাচ্চার বাবা কানে চড় মারছে, লজ্জায় এ কথা বলতে পারি নাই।’
ততক্ষণে স্বামী মহাশয় লজ্জায় লাল হয়ে বললেন, ‘স্যার, মানে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় মাথা গরম হয়ে গেছিল, তাই একটু আস্তে করে চড় দিছিলাম, আর হবে না।’
ঘটনা ৩
এক প্রৌঢ়া এসেছেন, সঙ্গে একেবারে কিশোরী বয়সের এক মেয়ে। নাক ফোলা, রক্ত আসছে। ওই প্রৌঢ়া বললেন, ‘স্যার, এইডা আমার পুতের বউ, সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে, কামকাজে মন নাই, তাই জা আর ভাশুর একটু শাসন করছে, তাই নাকে আঘাত লাইগ্যা রক্ত আসতেছে, আপনার যা যা দরকার করেন, চিকিৎসায় যেন গাফিলতি না হয়।’ বললাম, রোগীর এক্স-রেসহ কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা লাগবে, তার পর নাকে ব্যান্ডেজ করতে হবে। হাসপাতালে দুদিনের মতো থাকা লাগবে। এতে ওই নারীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। বাইরে দাঁড়ানো মলিন কাপড়চোপড় পরা এক নারীকে ডেকে আনল। ‘দেখো, তোমার মাইয়ার জন্য অহন আমাদের কত টেকা খরচ হইব।’ বেয়াইনও বউকে শাপশাপান্ত করতে লাগলেন। আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র লিখে পরীক্ষা করতে পাঠিয়ে দিলাম। অবশ্যই ব্যবস্থাপত্রের কোনায় ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে যথাসম্ভব কম রাখার জন্য অনুরোধ করে। একটু পর মেয়ের মা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। কিছু একটা বলতে চান।
আমি ডেকে এনে বললাম, ‘কী বলতে চান, বলেন।’ তিনি ইতস্ততভাবে এদিক-সেদিক দেখে চুপ করে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাগজে-কলমে মেয়ের বয়স দিয়েছেন ১৮, কিন্তু দেখতে তো আরও কম মনে হয়।’ উত্তরে বললেন, ‘স্যার, মেয়ের বাপ আরেকটা বিয়া কইরা চইলা গেছে। আমি তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়া বড় বিপদে। তাই নিজের খালাতো বোনের বড় ছেলের সাথে মাইয়ার বিয়া দিসি। জামাই সৌদিতে দোকানে কাজ করে, আয় রোজগার খারাপ না। টেলিফোনে বিয়া হইছে। তবে ছেলে এখনো বিয়ার পর দেশে আহে নাই। মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে রাখছে শাশুড়ির সেবা-যত্নের জন্য। স্যার, আমার মাইয়ারে বাঁচান। নাকে আঘাত লাইগ্যা প্রচুর রক্ত গেছে। এর আগেও মেয়ের গায়ে হাত দিসে। গ্রামে বিচার সালিস বসছে। আমরা গরিব মানুষ। টেকার জুর নাই। গেরামের মাতব্বরেরা সব হেদের পক্ষে। কইছে মাইয়া চঞ্চল, মাঠে-ঘাটে ঘুইরা বেড়ায়, গাছে উডে, শাশুড়ির সেবা করে না। প্রয়োজনে হেরা এই মাইয়ারে ফেরত পাঠাইয়া দিব। দরকার হইলে হেরা আরও শিক্ষিত মাইয়া আনব।’
এক নিশ্বাসে বলে গেলেন। ওই নারীর চোখে-মুখে অসহায়ত্ব দেখে আমার চোখও ঝাপসা হয়ে ওঠে।
এই সমস্যা আমি নাক কান গলা রোগের চিকিৎসক হিসেবে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পাই। ইদানীং করোনাকালে এ ধরনের সমস্যা আরও বেড়েছে। নারীর ওপর সহিংসতা এখন সমাজের সর্বত্র। কানে বাজে, মায়েদের অসহায় স্বগতোক্তি, ‘জামাইটা বালা পড়ে নাই’, বা ‘স্যার, আমরা গরিব মানুষ, আমার মাইয়াডারে বাঁচান।’
এ যেন নিয়তিকে মেনে নেওয়া। কপালের লিখন মেনে নেওয়া।