সে বেশ অনেক দিন আগের কথা, কমবেশি সতেরো বছর। রাজশাহীর পুঠিয়ায় লোকনাট্য গবেষক কাজী সাঈদ হোসেন দুলালের বাড়িতে দলবলে উপস্থিত হয়েছি ভোরবেলা। তাঁকে আমরা দুলালদা বলে ডাকতাম। তিনি বসতে দিয়ে মাটির কলস থেকে কাচের গ্লাসে ঢেলে দিলেন খেজুরের রস। চুমুক দিতে যাব তার আগে তিনি গ্লাসে এক মুঠো করে মচমচে মুড়ি ফেলে দিলেন। বললেন, ‘এবার ছোট ছোট চুমুক দিয়ে খা।’ সেই প্রথম খেজুরের রসে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়া। সে ছিল অভিনব অভিজ্ঞতা। তারপর বহুবার খেয়েছি বিভিন্ন জায়গায়।
পৌষের রোদমাখা দিন আর ফিরে আসবে না। কারণ এ লেখাটি যখন পড়ছেন, তখন দুলালদা আর পৌষ মাস উভয়েই চলে গেছে। দুলালদা না-ফেরার দেশে আর পৌষ মাস সংক্রান্তির মুহূর্তে। অর্থাৎ আজ পৌষ মাসের শেষ। আগামীকাল থেকে মাঘ মাসের শুরু। এটি মকরসংক্রান্তি হিসেবেও পরিচিত। পৌষসংক্রান্তি মানেই পিঠা খাওয়ার ধুম। শুধু পিঠা খাওয়াই নয় অবশ্য। আজ পুরান ঢাকায় পালন করা হবে সাকরাইন। ওড়ানো হবে রঙিন ঘুড়ি। আর তার অনুষঙ্গ হিসেবে খাওয়া হবে পিঠাপুলি।
খেজুরের রসে মুড়ি ভিজিয়ে খাওয়ার কথাই মনে পড়ল, রাজশাহীতেই দেখেছি ভোরবেলা মাটির কলসে খেজুরের রস ফেরি করে বিক্রি করতে। ‘খেই’ বলে দীর্ঘ স্বর যখন খাদে নেমে ‘জুর’ হয়ে যেত প্রথম প্রথম পুরো শব্দটা মেলাতে কষ্ট হতো। কিছুদিন পরে ‘খেই’ শুনলেই আমরা বুঝে যেতাম, খেজুরের রসওয়ালাএসেছে। কখনো কখনো অনেকের ‘হক’ মেরে আমরা চারজন মিলে সাবড়ে দিয়েছি গোটা দুই মাটির কলসে ভরা খেজুরের রস। সেসব আজ থেকে বছর বিশ আগের স্মৃতি।
উত্তরবঙ্গে পাওয়া যায় খুব কম। দক্ষিণেও যে পাওয়া যায় খুব, তা বলা যাবে না। তবে যশোর-খুলনা অঞ্চলে তার উপস্থিতি রয়েছে বেশ খানিকটা। যার কথা বলা হচ্ছে তার নাম খেজুরগাছ। শীতকালে খেজুরের রস আমাদের দেশে মহার্ঘ্য বস্তু হয়ে ওঠে। শীতের নরম রোদে পিঠ পেতে দিয়ে গাছ থেকে সদ্য নামানো খেজুরের রসে মচমচে মুড়ি দিয়ে খাওয়ার আলাদা এক আনন্দ আছে। তার স্বাদটাই অন্য রকম। খেতে হবে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে। মুড়ি শেষ হলে আবার নিতে হবে। রস শেষ হলেও গ্লাস পূর্ণ করে নিতে হবে। আমাদের দেশে ‘সাকি’ জিনিসটি নেই বলে গ্লাসটি নিজেকেই পূর্ণ করে নিতে হবে। বড়জোর পাশের জন ঢেলে দেবে গ্লাসে। খেজুরের রসে মাদকতা নেই আর এটি মৃদু মিষ্টি বলে খাওয়া যায় পরিমাণে অনেক। চাইলে একদিন খেতেই পারেন শীত শেষ হওয়ার আগে।
খাবারটির নাম খেজুরের রসের ক্ষীর। হ্যাঁ, কোনো কোনো অঞ্চলে খাওয়া হয় বটে। ওই যে রস পাওয়াই যায় না সব অঞ্চলে। সে জন্যই। রেসিপিটি জেনে রাখুন। কখনো সুযোগ এলে বানিয়ে রসনাবিলাস করে নেবেন।
রেসিপি
উপকরণ হিসেবে লাগবে খেজুরের রস ২ লিটার, চিনিগুঁড়া চাল ২ মুঠো, তেজপাতা আর ছোট এলাচি। উপকরণ সংগ্রহ হয়ে গেছে ধরে নিলাম। এবার খেজুরের রস তেজপাতা আর এলাচি দিয়ে জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিন। এই রসে আগে থেকে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা সুগন্ধি চাল দিয়ে রান্না করুন যতক্ষণ না চাল গলে আঠালো হয়ে আসে। তারপর পছন্দমতো ঘন হয়ে এলে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিন। গরম-গরম না খেয়ে একটু ঠান্ডা করে খেলে আলাদা স্বাদ পাবেন। এতে আলাদা করে গুড়, চিনি বা দুধ মেশাতে হবে না।