Ajker Patrika
হোম > ছাপা সংস্করণ

বাঁচার প্রেরণা হিসেবেই শিল্পচর্চা

মামুনুর রশীদ

বাঁচার প্রেরণা হিসেবেই শিল্পচর্চা

ওয়াশিংটন ডিসিতে এসেছি বইমেলার উদ্বোধন করতে। শুধু তা-ই নয়, বইমেলার নানান অনুষ্ঠানে অংশ নিতেও। বইমেলা হবে ২৬ ও ২৭ আগস্ট। একটু আগেই চলে এলাম। কারণ টেক্সাসের ডালাসে আমার দুটি আগ্রহ ছিল—আমার পুত্র এখানে থাকে এবং আকৈশোরের সেই কাউবয় ছবির পটভূমি এই টেক্সাস।

আসার পর একটা আনন্দময় ঘটনা ঘটে গেল। এখানে এসেই চারদিকের টেলিফোন। এখানকার বাঙালিদের নাট্য সংগঠন ডালাস বাংলা থিয়েটারের নাটক হবে পরের দিন। আগাথা ক্রিস্টির গল্প অবলম্বনে আব্দুস সেলিমের অনুবাদে নাটক ‘মাউস ট্র্যাপ’। লন্ডনে নাটকটি চলছে ৭০ বছর ধরে। বন্ধুবর সেলিমও নিউইয়র্ক থেকে এসেছেন, সঙ্গে আমাদের নাটকের জাদুঘরের উদ্যোক্তা ড. বাবুল বিশ্বাস। আমার প্রবল উৎসাহ ডালাস শহরের বাইরে কাউবয়দের রাজ্যে যাব। তা আর হলো না। নাটক দেখতেই গেলাম। বেশ কজন অভিনেতা আমার পূর্বপরিচিত, বন্ধুপ্রতিম। আনিসুজ্জামান মানিক, জিয়া—ওদের সঙ্গে ঢাকাতেই বহুদিনের সম্পর্ক।

যা-ই হোক, নাটক দেখে আমরা মুগ্ধ। প্রবাসে নানা কর্মব্যস্ততার মধ্যেও এ রকম একটি সফল প্রযোজনা ওরা কী করে করল! পরিচালক শিশির আমার আত্মীয়, ভ্রাতুষ্পুত্র। তার স্ত্রী নাবিলা নূর, সহকর্মী চিত্রলেখা গুহর মেয়ে আনিলা এবং টাঙ্গাইলের মেয়ে আল্পনা অসাধারণ অভিনয় করেছে। অন্য অভিনেতারাও পেশাদারির কাছাকাছি চলে গেছে।

নানা কারণেই দেশে এবং বাইরের অনেক জায়গায়ই নাটক দেখতে যেতে হয়। কখনো কখনো খুবই খারাপ অভিজ্ঞতায় পড়তে হয়েছে। সেদিক থেকে এই নাটক অসাধারণ। নাটক শেষে আবার ঘোষণা হলো, আমাদের মঞ্চে যেতে হবে। আমাকে আবার আজীবন সম্মাননা দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে সেলিম ভাই ও বিশ্বাসকেও। কামরুজ্জামান রুনু একসময় থিয়েটারের হয়ে একজন অসাধারণ নাট্যকর্মীর স্থান দখল করেছিল। সে-ও দীর্ঘদিন যাবৎ এখানেই। এখানকার নাটকে সে বেশ কিছু শিষ্য তৈরি করেছে। তাকেও সম্মাননা দেওয়া হলো।

আমাকে দু-চারটা কথা বলতে হলো। কিন্তু কোনো অতিশয়োক্তি নয়, যা সত্যিকার অনুভব, তা-ই প্রকাশ করলাম। নাটকের পরের আবেগঘন মুহূর্তগুলো কাটিয়ে অপেক্ষমাণ অনিকের গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এই অনিকের মাধ্যমেই ওদের সঙ্গে যোগাযোগটা ঘটেছিল।

শনিবারের রাত। নানা জায়গায় মানুষের ভিড়। আমার ইচ্ছা ছিল আমেরিকার বেদনার গান ‘ব্লুজ’ শুনব। নাটকের মঞ্চ থেকে তা বেশ দূর। জায়গাটা প্রাচীন টেক্সাসের ষাঁড় কেনাবেচা ও পরিবহনের জায়গা। ওখানেই গড়ে উঠেছে গানের একটা আসর। ব্লুজ, জ্যাজ ছাড়াও ওখানে কান্ট্রি মিউজিক হয়। পথেই পড়ে গেল কেনেডি হত্যার জায়গাটি। সেটি দ্রুত দেখেই আমরা চললাম বিলি ববস জায়গাটিতে।

একটু আগেই যে বললাম, যেখানে একদা ষাঁড়ের রাজত্ব ছিল, তার নাম ফোর্ট ওয়ার্থ স্টকইয়ার্ড। সেখানে পৌঁছেই দেখলাম, হাজার হাজার সংগীতপিপাসু আমেরিকানের ভিড়। কেউ ঢুকছে, কেউ বেরিয়ে যাচ্ছে। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষের আনাগোনা। ওখানে সারা দিনই নানা ধরনের পর্যটক আসে, বিরাট লম্বা শিংওয়ালা সব ষাঁড়ের যাতায়াত দেখতে। ষাঁড়ের জন্য হাঁটাচলার ব্যবস্থা আছে, পানি ও খাবারের ব্যবস্থা আছে। ষাঁড়ের এত বড় শিং আমি জীবনে দেখিনি। এ প্রসঙ্গে পরে বলব। আমাদের পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় বিখ্যাত গায়কদের গান পুরোটা শোনা হলো না। তবে কান্ট্রি মিউজিক শুনতে পেলাম। আলো ঝলমল রাতের আবেশ নিয়ে ফিরে এলাম। অনিক (আমার ছেলের শ্যালক) ও তার শিশুপুত্রের আমেরিকান ইতিহাসে প্রবল আগ্রহ। শিশুপুত্রটি বলছিল, এই টেক্সাস ছিল মেক্সিকো রাষ্ট্রের অধীনে। ১৮৪৩ সালে আমেরিকানদের সঙ্গে যুদ্ধে মেক্সিকোর সেনাবাহিনীর পতন হয়। পতনের কারণ হচ্ছে, মেক্সিকোর সৈনিকেরা দুপুরে খাবারের পর ঘুমায়। সেই ঘুমের মধ্যেই আমেরিকানরা আক্রমণ করে। ফলে মেক্সিকো পরাজিত হয়।

যা-ই হোক, ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘুম নেমে আসে। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে—বড় বড় সব প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বড় বড় শিংওয়ালা ষাঁড় আর কাউবয়রা ঘুরে বেড়াচ্ছে অস্ত্র হাতে; তারা ঘোড়ায় চড়ে এসে একটা যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়!

পরদিন সকালেই রওনা দিই পাইলট পয়েন্ট নামে এক জায়গায়। এবার আমার পুত্রবধূও আমাদের সঙ্গে এল। কয়েক দিন আগেই সে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছে। সে-ও ইতিহাস ও ভ্রমণে যথেষ্ট আগ্রহী। গাড়ি চলছে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে। জনমানবশূন্য প্রান্তর। ইউজিন ও’নিলের সেই নাটকের নামটি মনে পড়ল, ‘আহ ওয়াইল্ডারনেস’, বাংলায় ‘সেই নিরালা প্রান্তর’। রাস্তার দুই পাশে বিশাল সব খামার। কিন্তু কোথাও কোনো খামারি নেই। খামারের শস্য কাটা শেষ। বেশ অনেক সময় পার হওয়ার পর কিছু ঘরবাড়ি দেখা গেল। আর এক জায়গায় এসে দেখলাম কিছু প্রাচীন বাড়ি, যেখানে এলাকার প্রভাবশালী লোক, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার লোকেরা একদা থাকত। এখন সেখানে মাত্র কয়েকটা দোকান, একটা কফি শপ।

কফি শপের ভেতরে ঢুকতেই একটা নাটকের পোস্টার চোখে পড়ল। অস্কার ওয়াইল্ডের নাটক ‘ইম্পোরট্যান্স অব বিয়িং আর্নেস্ট’, একটি কমেডি। ওখানেই একটা মঞ্চে অভিনীত হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতেই এক লোক মঞ্চটি দেখিয়ে দিল। প্রখর খরতাপ। রোদের চরিত্রটাই এমন যে চামড়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে কামড়াতে থাকে। কিন্তু মঞ্চে এবং টিকিট ঘরেই শীতাতপের ব্যবস্থা আছে। আমরা তিনজনের জন্য টিকিট কিনলাম। ঠান্ডা কিছু পান করব, দাম নিল না। একটা কাচের বাক্স দেখিয়ে দিল। যার যা কিছু ইচ্ছা, ওখানে দিতে পারে। না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। মঞ্চটিও ছোট, দর্শকও খুব বেশি ধরবে না। ওই প্রখর রোদে বেলা আড়াইটায়ও বেশ কিছু দর্শক। মঞ্চের পাশ দিয়ে একটা রেললাইন গেছে। নাটক শুরুর আগে সব জায়গাতেই একটা ঘোষণা হয়। এখানেও ঘোষণার সময় বলে দিল, ‘আপনারা চিন্তা করবেন না, যখন ট্রেন ওখান দিয়ে যাবে, তখন আমরা অভিনেতাদের শব্দ প্রক্ষেপণ বাড়িয়ে দেব।’

নাটক শুরু হয়ে গেল। বেশ প্রাণবন্ত অভিনয়। সংলাপনির্ভর নাটক। আমেরিকান উচ্চারণের সঙ্গে দ্রুতলয়ের সংলাপ বুঝতে অসুবিধা হয়। কিন্তু দেহের ভাষায় অনেকটা বুঝতে পারি। দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও অনেকটা বুঝতে পারি। দুবার বিরতির পর নাটকটি শেষ হয়। বিরতির পরে নাটকের কর্তৃপক্ষ সব দর্শক ভেতরে না ঢুকলে নাটক শুরু করে না। ব্যবস্থাপনার লোকেরা ডাকতে থাকেন। এ-ও অভিনব!

নাটক শেষে লাউঞ্জে এসে সব অভিনয়শিল্পী দাঁড়ান। দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেন। আমার পুত্রবধূ ড. শবনম ও পুত্র পল্লব দুজনেরই কৌতূহল প্রবল। নানা প্রশ্ন তাদের। আমি ভেবেছিলাম, দলটি বোধ হয় ভ্রাম্যমাণ। কিন্তু জানা গেল, দলটি ওই এলাকারই। তাঁরা সবাই শৌখিন। নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তবে প্রায় প্রতিদিন এবং ছুটির দিনে নিয়মিত মহড়া করে থাকেন। বিভিন্ন বয়সের অভিনয়শিল্পী আছেন। তিন-চারজন অভিনেত্রীকে পাওয়া গেল, যাঁরা এই নাটকে প্রথম অভিনয় করেছেন।
দলটি কোনো সরকারি অনুদান পায় না। তবে এলাকার কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি সাহায্য করে থাকেন। দলটির একটি চমৎকার নামও আছে, ‘গ্যারেজ ডোর থিয়েটার’। আর মঞ্চটি চলে পাইলট পয়েন্ট কমিউনিটি অপেরা হাউসের নামে। স্যুভেনিরে তারা দলের মিশন হিসেবে ঘোষণা করেছে এভাবে: থিয়েটারের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তারে তাঁরা কাজ করবেন এবং সবশেষে বলেছেন তাঁদের প্রতিভা, অর্থ এবং ঘাম সবকিছু তাঁরা বিলিয়ে দেবেন শিল্পকলার মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে।

আমাদের দেশেও একদা শখের থিয়েটার, যাত্রা, কবিগান—এসব হতো কিছু উদ্যমী প্রতিভাবানের সৌজন্যে। তাঁরা কখনোই শহরমুখী হতেন না, কোনো উচ্চাশাও তাঁদের ছিল না। এলাকার মানুষদের জন্যই ছিল তাঁদের এসব উদ্যোগ। নাটকগুলোতে যেসব বার্তা বহন করত তা উচ্চ মূল্যবোধ নির্মাণ করত। দুর্ভাগ্য এসব উদ্যোগের অভাবেই এখন একটা উদ্দশ্যবিহীন সমাজ গড়ে উঠছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখেছি, একেবারে শহর থেকে অনেক দূরে গণ্ডগ্রামে নাটক আছে, গান আছে এবং এলাকার মানুষজন নিয়মিতই এই চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিদিন নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়ে থাকে।

টেক্সাসে আমার মাত্র কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় একটি প্রবাসের নাট্যদল দেখে মনে হলো হাজার হাজার মাইল দূরে আত্মীয়-পরিজন, আজন্মের চেনা পরিবেশ ছেড়ে মানুষগুলো কী করে বাঁচবে? সেই বাঁচার একটা প্রেরণা হিসেবেই এখানে শিল্পচর্চার প্রয়োজন অপরিহার্য। এভাবে বাংলা ভাষা ও শিল্প বেঁচে থাকবে। পাইলট পয়েন্ট আর ডালাস বাংলা থিয়েটারের নাট্যচর্চা আসলে সেই লক্ষ্যেই ধাবিত হচ্ছে দেখে একটা নতুন প্রেরণায় ঋদ্ধ হলাম।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ

ঢাকা সড়ক পরিবহন: প্রশ্নবিদ্ধ কমিটিতেই চলছে মালিক সমিতির কার্যক্রম

৪০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করবে টিসিবি

৮ বছরে শিশুহত্যা হয়েছে ৪০০০

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির শীর্ষে বাংলাদেশ, তবে বাজারে পিছিয়ে

দেশে ব্যবসায় ঘুষ–দুর্নীতিসহ ১৭ রকমের বাধা

বিদ্যালয়ের জমিতে ৩৯১টি দোকান, ভাড়া নেয় কলেজ