মা-বাবা কিংবা বংশের কারোরই অটিজমের কোনো ইতিহাস নেই। তারপরও জন্মের পর বিশেষ এই বৈশিষ্ট্য বহন করছে আহনাফ সুমন সরকার। বর্তমানে বয়স ১১ বছর হলেও আনহাফ পারে না অর্থবহ কোনো কাজ করতে। কথাও তেমন একটা বলে না। মাঝেমধ্যে অকারণে উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে আহনাফকে। এতে আগের তুলনায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো স্বাভাবিকে ফেরেনি সে।
ছেলেকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন বাবা সুমন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সন্তানের এমন অবস্থা দেখে খুবই কষ্ট লাগে। কোনো আত্মীয় যেমন আমাদের বাসায় আসতে চায় না, আমরাও যেতে পারি না। আশপাশের লোকজন পাগল মনে করে। এ কারণে করোনা মহামারিতেও কয়েকবার বাসা পরিবর্তন করতে হয়েছে।’
শুধু আহনাফ নয়, দেশে তার মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অনেক শিশুই রয়েছে। অজ্ঞতার কারণে সমাজের অনেকেই এদের পাগল মনে করে, অবহেলার চোখে দেখে। অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা সচেতন হলেই এসব শিশুকেও আনন্দময় জীবন দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা।
সরকারি জরিপ বলছে, ১০ বছর আগে দেশে যে সংখ্যক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ছিল, বর্তমানে সেটি বেড়েছে। তবে বাড়ার হার কেমন, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিজঅ্যাবিলিটি ডিডাকশন সার্ভিসের (ডিডিএস) আওতায় এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর নিবন্ধন করা গেছে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) বিভাগের চার বছর আগের তথ্য বলছে, দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা ৩ লাখেরও বেশি। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে সবাই নিবন্ধনের আওতায় না আসায় অটিজমে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা বের হয়ে আসছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অবস্থা নিয়ে দেশে ২০১৩ সালে প্রথম একটি মাঠপর্যায়ে জরিপ চালায় ইপনা। ওই জরিপে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৫ জন শিশু অটিজমের লক্ষণ বহন করে বলে তথ্য উঠে আসে। চার বছর পর ২০১৮ সালে আরও জরিপ পরিচালনা করে সংস্থাটি। যেখানে দেখা যায়, ১০ হাজারে ১৭ জন শিশু বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যের।
ইপনার ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নিউরোলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মাজহারুল মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের তুলনায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় শনাক্ত বেড়েছে। তবে এ জন্য শুধু যে সরকারি পদক্ষেপ, তা কিন্তু নয়। অভিভাবকদের সচেতনতাও বড় ভূমিকা রাখছে। অটিজমের বাচ্চাদের শনাক্তকরণে তিন ধরনের লোক দরকার—ডাক্তার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও থেরাপিস্ট। ঢাকায় যত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছে, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাসহ অন্যান্য বিভাগে নেই। এটা করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল বসানো গেলে তবেই প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অটিজম মনিটরিং সেলের পরিচালক ও বিএসএমএমইউ হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘বিশেষ এই চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অধিকাংশ পারিবারিকভাবে অবহেলার শিকার হোন। সরকার এই ধরনের অবহেলিত, দরিদ্র শিশুদের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। একসময়ে এ ধরনের বাচ্চাদের অভিভাবকেরা ঘর থেকে বের করতেন না। এখন অভিভাবকেরা বাচ্চাদের নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে আসেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যান। তাঁরা পরিচয় দেন আমার বাচ্চা অটিস্টিক। যেটি ১০ বছর আগেও ছিল না।’
গোপেন কুমার বলেন, ‘অভিভাবকেরা বুঝতে পেরেছেন, হাসপাতালে গেলে বাচ্চাদের জন্য চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা হবে। আমাদের এখানে সাতজন কনসালট্যান্ট আছেন। আরও জনবল তৈরি হচ্ছে, অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তবে এখনো লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারিনি, যেখানে একটা স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে এই শিশুও একই সঙ্গে স্কুলে পাঠানো, ভরণপোষণ—এগুলোও করা সম্ভব হবে। তবে ভবিষ্যতে এটি সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করি।’