রাত পোহালেই একুশে ফেব্রুয়ারি। শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর ভেতরের দিকে চলছে সোলা দিয়ে তোড়া বানানোর তোড়জোড়। সাদা সোলার ওপরে গাঁথা হচ্ছে গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা। আজ ভোরের মধ্যে এই ফুল চলে যাবে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সংগঠন ও মানুষের হাতে হাতে, রাত পোহালে শহীদ মিনারে। একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন তাই এই এলাকায় ব্যস্ততা বেশি।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস। ভাষাকে গুরুত্ব দিতেই এই দিন। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম বাংলা ভাষায় অনেক কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে। সাহিত্যের ভাষা বদলে যাচ্ছে দিন দিন। সাহিত্যের ভাষা আর মুখের ভাষা কেমন হওয়া উচিত—এ নিয়ে বইমেলায় বিতর্ক হওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা। তরুণ লেখকেরা যেমন, জ্যেষ্ঠ লেখকদের অনেকেই তেমনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় মুখর থাকেন।
মুখের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা কিছুটা আলাদা থাকা উচিত বলে মনে করেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। ‘ইদানীং আমরা ঘরে-বাইরে যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষায় গল্প বা উপন্যাস কিংবা নাটকের সংলাপগুলো লিখি। একটা সময় আমরা বিশুদ্ধ ভাষায় সংলাপ লিখেছি। গ্রামের পটভূমিতে উপন্যাস লিখতে গেলে সেই অঞ্চলের ভাষাকে প্রাধান্য দিই। আবার বর্ণনার সময় প্রমিত ভাষা ব্যবহার করা হয়।’ তাঁর ভাবনার কথা বলে গেলেন ইমদাদুল হক মিলন। সাহিত্যের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করা হলে প্রেক্ষাপট অনেক সময় মেকি হয়ে ওঠে বলে মনে করেন তিনি। ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষায় কেউ বই লিখতে চাইলে সেটিও নিরীক্ষামূলক কাজ হতে পারে বলে মনে করেন ইমদাদুল হক মিলন। তবে যে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া হয়েছে, সে ভাষার সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার পক্ষপাতী তিনি। আবার তরুণ লেখক আহমেদ খান হীরক মনে করেন, মানুষের মুখের ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হওয়া উচিত।
ইমদাদুল হক মিলন ও আহমেদ খান হীরকের সঙ্গে কথা বলে মেলায় ঢুকছি আর ভাবছি, ভাষা বিষয়ে এই বহমান আলোচনার শেষ কোথায় আসলে!
বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির স্টলের সামনে। জানলাম, আহমদ ছফার উপন্যাসগুলো বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিনছেন ব্যাকরণ বই। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ থেকে দর্শনের বই দেদার বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন বিক্রেতারা। তরুণদের মধ্যে জীবনী কেনারও একটা প্রবণতা আছে। শিখা প্রকাশনী থেকে নতুন লেখকদের মধ্যে মুহাম্মদ বিন এমরানের গল্প ‘আলোবতীর কালো খাতা’, আশীব ফেরদৌস অংকনের মেডিকেল থ্রিলার ‘কান্তার’, তানভীর মেহেদীর লেখা ‘ডেল্টা ল্যান্ড’ বেশ ভালো বিক্রি হচ্ছে। স্টলের বিক্রেতারা জানান, এর মধ্যে কান্তার বইটির তৃতীয় মুদ্রণ আসবে এই বইমেলাতেই। এ ছাড়া মুহম্মদ জাফর ইকবালের বেশ কয়েকটি বই ও কিঙ্কর আহসানের ‘রং মশাল’ ভালো বিক্রি হচ্ছে শিখা প্রকাশনীর স্টল থেকে। মিজান পাবলিশার্সের স্টল থেকে অনীশ দাস অপুর অনুবাদ ও সম্পাদনায় ‘বেস্ট অব এডগার এলান পো’, এনায়েত রসুলের ‘রাসেলের চিঠি’, মো. মনিরুজ্জামানের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ (জেলাভিত্তিক) বইগুলো বিক্রি হচ্ছে ভালো।
শেষ দিকের এই বইমেলায় তাই পাঠক-দর্শকের ভিড় চোখে পড়ার মতো। বইমেলা অনেকের কাছেই এখন উৎসব হয়ে উঠেছে।