নেত্রকোনা প্রতিনিধি
বালুশ্রমিক জিন্নাতুল ইসলাম খোকন (২৫)। স্ত্রী রিনা আক্তার ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কয়েক দিন পরই এ দম্পতির ঘর আলোকিত করে আসবে সন্তান। তাকে নিয়ে কত পরিকল্পনা। কিন্তু দুটি বুলেটেই ওলটপালট হয়ে যায় সব।
৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন খোকন। দুপুরে গাজীপুরের বাসন থানার সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবস্থানকালে পেট ও ঊরুতে দুটি গুলি লাগে তাঁর। বন্ধুরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। কয়েক দিনের জন্য খোকন দেখে যেতে পারেননি তাঁর অনাগত সন্তানকে। সন্তানও বঞ্চিত হলো বাবার আদর-ভালোবাসা থেকে।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দলপা ইউনিয়নের ভূঁইয়াপাড়া গ্রামের মৃত মোস্তফা মিয়ার ছেলে খোকন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে খোকন সবার ছোট। গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তিনি। অভাবের কারণে আর পড়াশোনা সম্ভব হয়নি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছর আগে খোকনদের পুরো পরিবার নিয়ে গাজীপুর শহরে চলে যান বাবা মোস্তফা। সেখানে গিয়ে সবাই কারখানায় কাজ শুরু করেন। বছরখানেক আগে মোস্তফা মারা যান।
খোকনের বড় ভাই আশরাফুল এক কারখানায় চাকরি করেন। আর খোকন বালুর গাড়িতে শ্রমিকের কাজ করতেন। এক বছর আগে ময়মনসিংহের গৌরীপুর এলাকায় বিয়ে করেন খোকন।
তাঁর স্ত্রী রানী আক্তার বর্তমানে ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রানী। তিনি বলেন, ‘আমার তো আর কিছুই রইল না। পেটের সন্তান তার বাবাকে দেখার আগেই হারাল। সে-ও তার সন্তানকে দেখে যেতে পারল না। অভাবের সংসার কীভাবে চালাব? দুই চোখে অন্ধকার দেখছি।’
খোকনের মা চম্পা আক্তার বলেন, ‘খোকন বালুর গাড়িতে শ্রমিকের কাজ করত। তবে তার চলাফেরা ছিল ছাত্রদের সঙ্গে। জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যেত খোকন। তাকে নিষেধ করেও আন্দোলনে যাওয়া থেকে ফেরাতে পারিনি।’
চম্পা বলেন, ‘৫ আগস্ট দুপুরে বাসন থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয় খোকন। সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা ফোন করে জানায়, খোকন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সে জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে আছে। খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গিয়ে সেখানে তাকে মৃত অবস্থায় পাই।’
চম্পা আরও বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, পরিবার চালাতেই কষ্ট হয়। এর মধ্যে আয় করা ছেলেটা চলে গেল। ঘরে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। এই মহাবিপদ কীভাবে পাড়ি দেব? কীভাবে তাদের ভরণপোষণ করব। এমন বিপদ যেন আর কারও জীবনে না আসে। রাষ্ট্রের কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
‘মা হয়ে সন্তানের লাশ দেখা কতটা কষ্টের, সেটা একজন মা-ই কেবল জানেন। নাতিটা জন্মের পর তার বাবার মুখ দেখতে পারবে না। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে। সবকিছুর ভার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম’, বলেন সন্তানহারা এই মা। স্বজনেরা জানান, খোকনের মরদেহ ৬ আগস্ট গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।