রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় জন্মানো ‘উলফুল’ ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি ‘উলফুল’ উৎপাদন হয় বাঘাইছড়ি উপজেলায়। ‘ফুলঝাড়ু’ তৈরির মূল উপাদান এই ফুল বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠছেন এই অঞ্চলের মানুষ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাহাড়ে অনেকেই সেগুন ছেড়ে উলফুলের বাগানে উৎসাহী হচ্ছেন।
বাঘাইছড়ির ছোট-বড় সব পাহাড়ে উলফুল জন্মে। লাভজনক হওয়ায় জুমচাষ, ফল চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে উলফুলের চাষ হচ্ছে। চার-পাঁচ বছর ধরে উলফুলের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই উপজেলা।
বন বিভাগের তথ্যমতে, উপজেলার সাজেক, মাচালং, বাঘাইহাট, দোসর, সারোয়াতলী; সদর উপজেলার কালামুড়া পাহাড়, চার কিলো, নয় কিলো, রূপকারীসহ বিভিন্ন এলাকায় উলফুল জন্মে। পাহাড়ি-বাঙালিসহ নিম্ন আয়ের নারী-পুরুষ এই ফুল সংগ্রহ করেন। পরে ফুলের আঁটি বেঁধে স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করেন। উপজেলার চারটি স্থানে সাপ্তাহিক হাটের দিন জিপ, পিকআপে আনা হয় এসব ফুল।
ব্যবসায়ী সোলাইমান বলেন, প্রতি হাটে ২ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এতে সরকার ১০ লক্ষাধিক টাকার রাজস্ব পায়। পাহাড়ি নারীরা জুমচাষের কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সংগ্রহ করা ফুল দিয়ে তৈরি ঝাড়ু বাজারে নিয়মিত বিক্রি করেন।
চার কিলোপাড়ার বাসিন্দা জীবন চাকমা বলেন, ‘আমরা পাহাড় থেকে উলফুল কেটে আঁটি বেঁধে উপজেলা মাঠের পাশের বাজারে বিক্রি করি। ২০-২৫টি ফুলের শলাকা দিয়ে তৈরি হয় ঝাড়ুর আঁটি। প্রতি আঁটি ২০-৩০ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। প্রতিদিন ৫০-৬০ আঁটি তৈরি করা সম্ভব। এগুলো বাজারে বিক্রি করে সংসারে বাড়তি আয় হয়।’
এদিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি দামে উলফুল কিনে রোদে শুকিয়ে ঝাড়ুর আঁটি তৈরি করেন ব্যবসায়ীরা। পরে তা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে সরবরাহ করেন তাঁরা। বাজারে প্রতি হাজার উলফুল সাড়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে। একজন মানুষ দিনে পাহাড় থেকে এক-দেড় হাজার উলফুল সংগ্রহ করতে পারেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ফুলঝাড়ু ব্যবসায়ী সোপ্পলাল চাকমা জানান, চার বছর ধরে পাহাড়িদের কাছ থেকে পাইকারি দরে উলফুলের আঁটি কিনে ট্রাকে চট্টগ্রাম-ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করেন। বর্তমানে তাঁর অধীনে দুই শতাধিক নারী-পুরুষ উলফুল রোদে শুকানো ও ঝাড়ুর আঁটি বানানোর কাজ করছেন। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে পাহাড়ের মানুষের আর্থিক সংকট নিরসনে ফুলঝাড়ুশিল্প সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি মনে করেন।
ফুলঝাড়ু ব্যবসায়ী সাজাহান মুন্সি বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছ থেকে একটি কাঁচা ঝাড়ুর আঁটি ১৫-২০ টাকায় কিনে নিই। তারপর রোদে শুকিয়ে শ্রমিক দিয়ে নতুনভাবে ঝাড়ুর মোছা বানিয়ে ৪০-৫০ টাকা দরে বিক্রি করি।’
ঝাড়ু তৈরির শ্রমিক হ্যাপী চাকমা, সালমা খাতুনসহ কয়েকজন বলেন, পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা ফুল দিয়ে আঁটি তৈরির কাজ করে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পান তাঁরা।
উপজেলার কাঠ ব্যবসায়ী ও জোত মালিক সমিতির সভাপতি মো. গিয়াসউদ্দিন মামুন বলেন, ‘পাহাড়ে এখন উলফুলের মৌসুম। পাহাড়ে সেগুনবাগান করতে সময় ও শ্রম বেশি লাগে, কিন্তু উলফুল উৎপাদনে তা কম লাগে, লাভও বেশি। তাই অনেকেই সেগুন কাঠের বাগান ছেড়ে উলফুলের বাগানে উৎসাহী হচ্ছেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ের চূড়ায় উলফুলের বাগান পরিদর্শন করে মনে হয়েছে, এটি চাষে তেমন খরচ নেই। তবে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। উপজেলার কৃষি ও বন বিভাগের সমন্বয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে। যাতে এর চাষ আরও এগিয়ে নেওয়া যায়।’