সুমি আক্তার আর তাঁর মা রানা প্লাজার সাততলার একটি কারখানায় কাজ করতেন। সেদিন কারখানায় গিয়ে কাজ শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দে ভবন ধসে পড়ে। দৌড়ে বের হতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কয়েক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে দেখেন তাঁর ডান পায়ের ওপর দুটি লাশ আর লাশের ওপর ভবনের বিম। অনেক চেষ্টা করেও তিনি পা নাড়াতে পারছিলেন না। বেঁচে ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এভাবে কেটে যায় দুই দিন। তৃতীয় দিনে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সুমি গতকাল শনিবার সকালে বলছিলেন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারে রানা প্লাজা বিপর্যয়ের কথা। এ ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ মানুষ মারা যান। আহত হন প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ছিলেন পোশাকশিল্পের শ্রমিক।
সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। একটি পুলিশের করা হত্যা মামলা। অন্য মামলাটি ইমারত নির্মাণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের ফলে সৃষ্ট ত্রুটি এবং এ-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে করা হয়।
হত্যা মামলায় ঘটনার দুই বছরেরও বেশি সময় পর ২০১৫ সালের মে মাসে ভবনটির অন্যতম মালিক ও সাভারের স্থানীয় যুবলীগের নেতা সোহেল রানাসহ মোট ৪১ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।
রানা প্লাজাধসের জন্য ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিন বছর ঝুলে ছিল এই মামলা। সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল, যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করার অনুমতি দিতে পারবে না তারা।
প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই হত্যার অভিযোগে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। পরবর্তী সময়ে এ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন এ হত্যা মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বাদীর জবানবন্দি শেষ হলেও বাদীকে জেরা করা শেষ হয়নি।
আদালত সূত্র বলছে, রানা প্লাজাধস হত্যা মামলায় ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন ভবনের মালিক সোহেল রানা। জামিনে আছেন ৩২ আসামি। পলাতক ছয়জন। মারা গেছেন দুই আসামি।
ওই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী রাজউকের করা আরেকটি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে প্রায় ছয় বছর ধরে।
হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী ঢাকা জেলার অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (অতিরিক্ত পিপি) আনোয়ারুল কবির বাবুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী করা মামলাটি আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রিফাতুল্লাহ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত রয়েছে। ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার না হলে মামলার কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন শনিবার বলেছেন, তিনি খোঁজখবর নেবেন এবং স্থগিতাদেশ থেকে থাকলে তা প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগী হবেন।
ভবনধসের পর দুর্নীতি দমন কমিশনের করা সম্পদের হিসাব না দেওয়া বিষয়ক এক মামলায় সোহেল রানার তিন বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাস জেল হয়।