অনেক আশা নিয়ে পদ্মা আর গড়াইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। শুরুতে তাদের সম্পর্কটা অবশ্য ভালো ছিল না। দেখা হলেই তারা মারামারি করত। সেই মারামারির সম্পর্ক মধুর করা হয়েছে কৌশলে। এখন দুজন বেশ আছে। একসঙ্গে ডুবসাঁতার কাটে। রোদে শুয়ে গা পোড়ায়। মাছ ধরে, খায়। আবার মন চাইলে দুজনে হারিয়ে যায় পানির গভীরে।
একসঙ্গে থাকার দেড় বছর পর দুজনের ভাব জমে। তারপর পার হয়েছে আরও সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরে পদ্মা তিনবার ডিম দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সে ডিম ছেড়েছে পানিতে। ফলে ওই ডিম থেকে বাচ্চা ওঠেনি। বারবার পদ্মার এমন ভুলে বাবা হতে পারেনি গড়াই। অথচ পদ্মা-গড়াই মা-বাবা হবে এ আশাতেই তাদের একসঙ্গে রাখা হয়েছে।
পদ্মা আর গড়াই মিঠাপানির বিরল প্রজাতির কুমির, ঘড়িয়াল বলে যারা সমধিক পরিচিত। এই ঘড়িয়াল এখন বিলুপ্তির পথে। তাই পাঁচ বছর আগে ৩৭ বছর বয়সী পদ্মার সঙ্গে রাখা হয় ৪২ বছরের গড়াইকে। তারা থাকে রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার এক পুকুরে। পদ্মা ডিম দেবে বলে পুকুরের মাঝে একটা বালুর ঢিবি করে দিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। পদ্মা-গড়াই সেখানে উঠে রোদ পোহায়। কিন্তু পদ্মা ডিম দেয় না।
রাজশাহী চিড়িয়াখানায় আগে দুটি মাদি ঘড়িয়াল ছিল। ১৯৮৫ সালে পদ্মা নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়ে তাদের ঠাঁই হয় চিড়িয়াখানায়। আর ঢাকা চিড়িয়াখানায় ছিল চারটি পুরুষ ঘড়িয়াল। দুই চিড়িয়াখানায় একই লিঙ্গের ঘড়িয়াল থাকায় তাদের প্রজনন হচ্ছিল না। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) চিন্তা করে, দুই চিড়িয়াখানার ঘড়িয়াল বিনিময় করা হলে বিলুপ্তপ্রায় এ প্রজাতিটির প্রজনন সম্ভব। তারা প্রস্তাব দিলে দুই চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ রাজি হয়। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট রাজশাহী থেকে ‘যমুনা’ নামের এক ঘড়িয়ালকে পাঠানো হয় ঢাকায়। আর ঢাকা থেকে গড়াইকে এনে সঙ্গী করা হয় পদ্মার।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রথম দেড় বছর দুজন-দুজনের কাছে আসত না। হঠাৎ কেউ কারও সামনে পড়লে মারামারি শুরু করে দিত। তাই দুজনকে আলাদা করে খাবার দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে খাবার দেওয়ার মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনা হয়। একসময় দুজনকে একসঙ্গেই খেতে দেওয়া হয়। এভাবে তাদের ভাব জমে ওঠে।
এরপর ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার ডিম দিয়েছে পদ্মা। কিন্তু প্রতিবারই ভুল করে পানিতে ডিম দিয়েছে সে। এমন পরিস্থিতিতে এবার পদ্মার ডিমের জন্য ইনকিউবেটরের ব্যবস্থা করেছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এবার ডিম দিলেই তা তুলে ইনকিউবেটরে রাখা হবে। এর ফলে ডিম থেকে বাচ্চা উঠবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও ইনচার্জ ডা. ফরহাদ উদ্দিন বলেন, ‘ঘড়িয়ালের জন্য পুকুরের মাঝে বালু দিয়ে আইল্যান্ড করে দিয়েছি। সেখানে ডিম দিলে বাচ্চা উঠবে। কিন্তু পদ্মা বারবার পানিতেই ডিম দিয়েছে। সে হয়তো কখনও দেখেইনি যে কোথায় ডিম দিতে হয়। এ কারণে আমরা এবার নজর রাখছি। এবার ডিম দিলেই তুলে ইনকিউবেটরে রাখা হবে। দেশে এর আগে কোথাও ঘড়িয়ালের এই ‘ক্যাপটিভ ব্রিডিং’ হয়নি।’
কুমিরজাতীয় প্রাণীর মধ্যে ঘড়িয়াল দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রজাতি। বন্য পরিবেশে এরা ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচে। কেউ কেউ ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। পৃথিবীতে এখন ঘড়িয়াল টিকে আছে ২০০টিরও কম।