কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারায় সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণকাজ শুরু করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নেওয়ায় বনাঞ্চলের অংশে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ। বনের ভেতর সড়কটি নির্মাণ হলে পরিবেশ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছে বন বিভাগ।
এলজিইডি ও বন বিভাগ সূত্র বলেছে, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন থেকে বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ‘গ্রামীণ সড়ক’ মেরামত ও সংরক্ষণের আওতায় ইউনি ব্লক দিয়ে সড়ক সংস্কারকাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করে এলজিইডি। প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘মেসার্স নজরুল কনস্ট্রাকশন’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের কার্যাদেশ পায়। কার্যাদেশ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে দিকে কাজ শুরু করার কথা ছিল। আগামী জুনের মধ্যে কাজটি শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু গত বুধবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ শুরু করলে বন বিভাগের অংশে কাজে বাধা দেওয়া হয়।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহরাজ উদ্দীন এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কোনো ছাড়পত্র আছে কি না, জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাগজ দেখাতে ব্যর্থ হয়। এরপর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশে নির্মাণকাজে বাধা দিয়ে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দেখা গেছে, ডুলাহাজারা ইউনিয়নের নতুন পাড়া চৌমুহনী থেকে লিয়াকতের বাড়ি পর্যন্ত ইতিমধ্যে ৮০০ মিটার রাস্তার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। চৌমুহনী এলাকায় ২৫ থেকে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। সড়কের পাশে ইট ও বালু স্তূপ করে রাখা।
গ্রামবাসী জানান, দুদিন ধরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন। কিন্তু বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করাটা সমীচীন নয়।
স্থানীয় বাসিন্দা জাকের আহমদ ও হামিদুল আজাদ জানান, অনেক বছর পর সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হওয়ায় তাঁরা খুশি। তবে সংরক্ষিত বনের ভেতর সড়ক নির্মাণ হচ্ছে মর্মে বন বিভাগ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। বনের জায়গা ছাড়া সড়কের বাকি কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করার দাবি জানান তাঁরা।
বন বিভাগ সূত্র বলেছে, ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জে সংরক্ষিত বনের আয়তন ১১ হাজার ৯২ দশমিক ৩৪ একর। ১৯০৭ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করে এ বনকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। এই বনাঞ্চলে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের তালিকাভুক্ত মহাবিপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসস্থল রয়েছে। এ ছাড়া এখানে হরিণ, মেছোবাঘ, বানর, শিয়াল, বনমোরগ, শূকরসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী ও পাখির আবাসস্থল রয়েছে।
বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বনভূমিতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণসংক্রান্ত বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে বন বিভাগের মাধ্যমে বন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়া উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রাখতে বলা হয়।
সড়ক নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স নজরুল কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম টিটু বলেন, ‘এলজিইডি টেন্ডার আহ্বান করলে আমার প্রতিষ্ঠান কাজটি পায়। যথারীতি কাজ শুরু করলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বনের জায়গায় কাজ না করতে বলা হয়। বিষয়টি এলজিইডির উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলীকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
এলজিইডির চকরিয়া উপজেলা কার্যালয়ের প্রকৌশলী শাফায়েত ফারুক চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সড়কটি সংরক্ষিত বনের মধ্যে দিয়ে গেছে, তা জানতাম না। তবে সড়কটি আমাদের রোড আইডিভুক্ত। বান্দরবান আসনের সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং ও চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমের দেওয়া অনানুষ্ঠানিক চিঠির (ডিও লেটার) পরিপ্রেক্ষিতে সড়কটি অনুমোদন হয়ে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কাজ বন্ধের বিষয়টি এলজিইডির কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে এলজিইডি ও বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।’
ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মেহরাজ উদ্দীন বলেন, ‘বন বিভাগের পক্ষ থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অংশে নির্মাণকাজ না করতে বলা হয়েছে। সড়কটি নির্মাণ হলে বনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। বিষয়টি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’