আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর তাড়াহুড়ো করে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। তালেবান ও আশরাফ গনি সরকারসহ অন্য পক্ষগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া না করে রাতের আঁধারে মার্কিনিদের কাবুল ত্যাগকে ওয়াশিংটনের ভিন্ন কোনো পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।
এশিয়া টাইমসের তথ্যমতে, মে মাসে সিরিজ বোমা হামলায় কাবুলে অনেক স্কুলছাত্রীসহ অন্তত ৬০ জন নিহত হয়। এ ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অতর্কিতে সেনা প্রত্যাহারকে দায়ী করে চীন। তখন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং বলেছিলেন, সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের আরও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। এতে আফগানদের দুঃখ-দুর্দশা কিছুটা হলেও কমবে।
এখানে যে কথাটা তিনি মুখে বলেননি তা হলো, সমস্যার কোনো কূলকিনারা না করে, গভীর সমস্যার মাঝপথে যুক্তরাষ্ট্রের এভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়াটা চীনের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের।
কারণ, ১৯৮৮ সালে শুরু হওয়া ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) নিয়ে বেইজিংয়ের অনেক মাথাব্যথা। বহুজাতিক এ আন্দোলনে অনেক উইঘুর তরুণ রয়েছেন, যাঁরা সিরিয়ার ইদলিবসহ দেশটির উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। তাঁদের জিনজিয়াং স্বাধীন করারও পরিকল্পনা আছে, যা তাঁদের স্বপ্নের ইস্ট তুর্কিস্তানের অংশ হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো কিছু কোনোভাবেই বরদাশত করবে না চীন।
ইটিআইএমকে ২০০২ সালে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরে ট্রাম্প প্রশাসন সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে ইটিআইএমের নাম বাদ দেয়।
২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে সন্ত্রাসী হামলার জন্য এ সংগঠনটিকে দায়ী করে চীন। এ হামলায় সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আটজনের একটি তালিকাও প্রকাশ করে চীনা কর্তৃপক্ষ।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইটিআইএমের অন্তত ৫০০ সদস্য সক্রিয় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি একে অনেক দেশে বিস্তৃত একটি নেটওয়ার্ক বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এদিকে দুই সপ্তাহ আগে আফগানিস্তানের তাজিকিস্তান সীমান্তের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলা দখলে নিয়েছে তালেবান। অথচ নিজেদের শাসনামলেও মুজাহিদীনদের কারণে এসব অঞ্চলের পাশ ঘেঁষতে পারেনি তালেবান। এ ছাড়া, পাকিস্তানে নিষিদ্ধ লস্কর-ই-ইসলাম এবং তেহরিক-ই-তালেবানের সঙ্গেও ইটিআইএমের বোঝাপড়া রয়েছে।
বিদেশি অর্থ ও অস্ত্রে উল্লিখিত অঞ্চলগুলোয় ইটিআইএমের কার্যক্রম বাড়লে, এতে চীনের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ (বিআরআই) উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বেইজিংয়ের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট। কারণ, আলোচিত জিনজিয়াং প্রদেশের মধ্য দিয়ে এসব অঞ্চলে চায়না সেন্ট্রাল এশিয়া-ওয়েস্ট এশিয়া ইকোনমিক করিডর, নিউ ইউরোশিয়া ল্যান্ড ব্রিজ ইকোনমিক করিডর, চায়না-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া ইকোনমিক করিডর, চায়না–পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের মতো কোটি কোটি ডলারের প্রকল্প চলমান রয়েছে চীনের, যা মোটাদাগে বিআরআইয়ের অংশ।
এ পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানকে কোনোভাবেই সিরিয়ার মতো আরেকটি হাইব্রিড রণক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চায় না চীন। তেহরান, মস্কো ও ইসলামাবাদ বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় ভূরাজনৈতিক দিক থেকে আফগান বিষয়ে এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছে চীন। কিন্তু জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে করা কৌশলগত জোট কোয়াড বা ইটিআইএমের মতো বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপকে কাজে লাগিয়ে এখানে বড় ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে ওয়াশিংটন, যা বেইজিংকে নিঃসন্দেহে জটিল সংকটে ফেলবে।