Ajker Patrika

‘মা, আমি ক্লান্ত, আমি মরে যেতে চাই মা’, গাজার শিশুদের আকুতি কেউ কি শুনছে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৯ মার্চ ২০২৫, ২০: ২২
ফিলিস্তিনি শিশু সামার মাথায় চুমু খাচ্ছেন তার মা। ছবি: সিএনএন
ফিলিস্তিনি শিশু সামার মাথায় চুমু খাচ্ছেন তার মা। ছবি: সিএনএন

‘আমার সব চুল কেন পড়ে গেল? আর কি কখনোই চুল গজাবে না আমার মাথায়? মা, আমি ক্লান্ত, আমি মরে যেতে চাই মা! আমি বেহেশতে গিয়ে আবার চুল বড় করতে চাই!’ আয়নার সামনে চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গি করতে করতে কেঁদে ফেলে ছোট শিশু সামা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে বেশ লম্বা চুল ছিল সামার। বন্ধুদের সঙ্গে তখন সে বাইরে খেলতেও যেত। কিন্তু এখন চুল না থাকায় অন্য শিশুরা তাকে বুলি (উত্ত্যক্ত) করে, এটা একদম ভালো লাগে না তার। তাই সারা দিন ঘরের মধ্যেই থাকে। বাইরে গেলেও স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে। ফলে দিন দিন আরও বেশি অন্তর্মুখী হয়ে পড়ছে শিশুটি।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের আগে রাফায় নিজেদের বাড়িতে থাকত সামা। ইসরায়েলি হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে জীবন বাঁচাতে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে তারা। সবশেষ থিতু হয়েছে খান ইউনিসে।

সামার মা সিএনএনকে বলেন, গত বছরের আগস্টে ঠিক তাঁদের পাশের বাড়িতে আঘাত হানে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র। ভয়ে কুঁকড়ে যায় সামা। আর এরপর থেকেই শুরু হয় তার চুলপড়া। চুলপড়া বন্ধ করতে নানা চেষ্টা করা হয়েছে। ফল হয়নি। এখন একেবারেই টাক হয়ে গেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, নার্ভাস শকের (স্নায়বিক আঘাত) কারণে চুল পড়ে গেছে।

কিন্তু ছোট শিশুটি কি আর বোঝে এসব বিষয়? চুল না থাকার কষ্টে মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে। বেঁচে থাকার স্পৃহাই হারিয়ে ফেলেছে!

‘আমি খুব কষ্ট পাই, কারণ চিরুনি করার মতো একটা চুলও আমার নেই,’ মাথায় হাত রেখে সিএনএনকে বলে সামা। সে বলে, ‘আমি মুখের সামনে আয়না ধরে রাখি, আমি চুল আঁচড়াতে চাই: আমি সত্যিই আবার চুল আঁচড়াতে চাই!’

শুধু সামাই নয়, গাজার বেশির ভাগ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাই এমন শোচনীয়। তেমনই দুই শিশু আনাস আর তার বোন দোয়া। তাদের একজনের বয়স সাত আর অন্যজনের আট। ইসরায়েলি হামলায় বাবা–মা দু’জনকেই হারিয়েছে তারা। এখন দাদির সঙ্গে আল মাওয়াসির শরণার্থীশিবিরে থাকে। আনাস সিএনএনকে বলে, ‘আমি বল খেলছিলাম। একটা ড্রোনের শব্দ শুনতে পাই। তারপর সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখি মা–বাবা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।’

সিএনএন জানায়, আনাস কথা বললেও সাক্ষাৎকারের পুরো সময়টাতেই দোয়া নখ খুঁটছিল, অন্যমনস্ক ছিল। একটা সময় পর সে কাঁদতে শুরু করে।

বাবা–মা দুজনকেই হারিয়েছে দোয়া ও আনাস। ছবি: সিএনএন
বাবা–মা দুজনকেই হারিয়েছে দোয়া ও আনাস। ছবি: সিএনএন

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে গাজায় বর্তমানে শিশুর সংখ্যা ১২ লাখ, যাদের সবারই মানসিক সহায়তা প্রয়োজন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা টম ফ্লেচার বলেছেন, পুরো একটা প্রজন্ম ট্রমাটাইজড হয়ে গেছে। নির্বিচারে বোমা হামলা–গুলি চালানো হয়েছে তাদের ওপর, অভুক্ত রাখা হয়েছে, ঠান্ডায় জমে মৃত্যু হয়েছে, এমনকি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই জীবন দিয়েছে কত শিশু!

শিশু অধিকার বিষয়ক সংস্থা ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্স এবং কমিউনিটি ট্রেনিং সেন্টার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গাজার সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, গাজার ৯৬ শতাংশ শিশুই ধরে নিয়েছে, মৃত্যুই তাদের সম্মুখ নিয়তি। উপত্যকার ৪৯ শতাংশ শিশু আর বাঁচতেই চায় না। তাদের মতে—ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনে জীবন যতটা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়!

গাজার সবচেয়ে বড় মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কর্মসূচির পরিচালক ড. ইয়াসের আবু জামেই বলেন, গাজায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আবু জামেই বলেন, তাঁর কাছে যেসব শিশু আসে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এক শিশুর কথা উল্লেখ করেন জামেই। ওই শিশু তাঁকে বলেছিল, ‘আমার অনেক বন্ধু বেহেশতে চলে গেছে। কিন্তু আমার একটা বন্ধুকে ওরা খুঁজে পায় মাথা ছাড়া। আমিও দেখেছি সেটা। কিন্তু ও মাথা ছাড়া কীভাবে বেহেশতে যাবে?’

জামেই বলেন, সহায়তা নিতে আসা শিশুদের কেউ কেউ এতই ট্রমাটাইজড যে তারা তাদের কষ্টের কথা বলতেও পারে না। তখন তাদের ছবি আঁকতে বলা হয়। তাদের আঁকা ছবি থেকেই ধারণা করতে পারা যায়, কতটা কষ্ট-আতঙ্ক আছে তাদের মনে!

গাজার শিশুদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ইসরায়েলি মনোবিদেরাও। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসরায়েলি মনোবিদ এডনা ফোয়া সিএনএনকে বলেন, ‘কান্না বা চিৎকার-চেঁচামেচি করে যেসব শিশু নিজের মনের ভাব প্রকাশ করছে তাদের নিয়ে আমি আশাবাদী। কিন্তু যারা একদম চুপ হয়ে গেছে, ভাবলেশহীন চোখে যারা এদিক–সেদিক শুধু তাকিয়ে থাকে, তাদের নিয়ে আমি চিন্তিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘গাজার শিশুদের যে পরিমাণ ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এরপর তারা আর কখনোই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। এটা কঠিন হলেও সত্য। তবে, এখন তারা যতটা খারাপ আছে তার চেয়ে অনেকটাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত