রাজু নিশাদ। ভারতীয় এক নির্মাণ শ্রমিক। নিরাপত্তা বেল্ট, হেলমেট ও লম্বা বুট পরে কাজ করেন ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় শহর বীর ইয়াকভের একটি নতুন নির্মাণাধীন আবাসন এলাকায়। তাঁর মতো আরও ১৬ হাজার শ্রমিক ইসরায়েলের নির্মাণ খাতে যোগ দিয়েছে বিগত বছর খানেক সময়ের মধ্যেই। তবে তাঁরা ইসরায়েলের নির্মাণ শিল্পে তুলনামূলক নতুন।
মূলত গত বছরের আগস্টে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশটি আর ফিলিস্তিনিদের কাজে নিচ্ছে না। ফলে, দেশটির শ্রমবাজারে লক্ষাধিক শ্রমিকের যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করতেই ভারতের দিকে নজর দিয়েছে ইসরায়েল। আর সেই সুযোগ লুফে নিয়েছে ভারত। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রায় ১৬ হাজার ভারতীয় শ্রমিক প্রবেশ করেছে। ভারত ও ইসরায়েল সরকারের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
যদি ইসরায়েলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ঘটনা না ঘটত তাহলে হয়তো ইসরায়েলের শ্রমবাজারে ফিলিস্তিনিদের কোলাহল থাকত। কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমানে ইসরায়েলের শ্রমবাজার হিন্দি, হিব্রু এবং এমনকি মান্দারিন ভাষায় মুখরিত।
হামাসের ওই হামলা ইসরায়েল ও গাজার হামাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধের সূচনা করে। পরে তা ইরান সমর্থিত অন্যান্য গোষ্ঠী—যেমন লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী এবং এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গেও সরাসরি সংঘর্ষে রূপ নেয়। তবে এই সংঘর্ষ ইসরায়েলের শ্রমবাজারে ভারতীয়দের প্রবেশ ঠেকায়নি।
নিশাদ বলেন, ‘এখানে ভয়ের কিছু নেই।’ যদিও একাধিকবার বিমান হামলার সতর্কতা তাঁকে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটতে বাধ্য করেছে। তিনি বলেন, ‘যখন সাইরেন থেমে যায়, তখন আমরা আবার কাজ শুরু করি।’
ইসরায়েলে উচ্চ উপার্জনের সম্ভাবনা আছে। সাধারণত, ভারতে একজন শ্রমিক দৈনিক যা আয় করেন, ইসরায়েলে তার চেয়ে অন্তত ৩ গুণ বেশি আয় করতে পারেন। আর এই বিষয়টিই নিশাদদের মতো ভারতীয়দের হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলে যেতে উদ্বুদ্ধ করছে। নিশাদ বলেন, ‘আমি ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করছি, বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছি এবং আমার পরিবারের জন্য অর্থবহ কিছু করার চেষ্টা করছি।’
বিগত বছরে ভারত থেকে প্রায় ১৬ হাজার শ্রমিক ইসরায়েলে গেলেও দেশটির আরও কয়েক হাজার—এমনকি সেটা লাখের ঘরেও ছুঁয়ে যেতে পারে—শ্রমিক নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি এবং সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর একটি হলেও দেশর কয়েক কোটি মানুষ এখনো পূর্ণকালীন চাকরির সন্ধানে সংগ্রাম করছে। আর এ কারণে, প্রতিবছর ভারত থেকে লাখ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কায়িক শ্রম বিক্রির জন্য যাচ্ছেন।
বিগত কয়েক দশক ধরেই হাজার হাজার ভারতীয় ইসরায়েলে কাজ করছে। বিশেষ করে, বৃদ্ধ ইসরায়েলিদের যত্ন নেওয়া, ডায়মন্ড ব্যবসা এবং আইটি শিল্পে ভারতীয়দের প্রাধান্য বেশি। তবে গাজার যুদ্ধ তীব্র হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি নিয়োগকারীরা দেশটির নির্মাণ খাতেও ভারতীয়দের নিতে শুরু করেছে।
দিল্লিভিত্তিক ডায়নামিক স্টাফিং সার্ভিসেসের চেয়ারম্যান সমীর খোসলা—যিনি ৩০ টিরও বেশি দেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় শ্রমিক পাঠিয়েছেন—এ পর্যন্ত ইসরায়েলে সাড়ে ৩ হাজারে বেশি শ্রমিক পাঠিয়েছেন। এই দেশ তাঁর জন্য একটি নতুন বাজার। খোসলা নিজে অক্টোবরের ৭ তারিখের হামলার এক মাস পর প্রথমবার ইসরায়েলে যান, সেখানকার নির্মাণ শিল্পে বিদেশি শ্রমিকদের চাহিদা সরেজমিনে বোঝার জন্য।
খোসলা বলেন, ‘আমরা (ইসরায়েলের নির্মাণ শিল্পে) বাজার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না এবং এখানে ভারতের কোনো শ্রমশক্তি ছিল না। আমাদের ঘুরে ঘুরে প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে, দুই দেশের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে শ্রমিক নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত ইসরায়েলের জন্য একটি স্বাভাবিক পছন্দ। তিনি আরও জানান, তিনি আশা করছেন, তিনি এখন প্রায় ১০ হাজার ভারতীয় শ্রমিক ইসরায়েলে পাঠানোর আশা করছেন।
তেল আবিবের কাছাকাছি একদল ভারতীয় একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকেন। যেখানে তারা নিজেদের নির্মাণ দক্ষতার পাশাপাশি বাড়ি থেকে আনা মসলাদার খাবার রান্না করাও শিখেছেন। সেখানকার বাসিন্দা ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে যাওয়া সুরেশ কুমার বর্মা (৩৯) বলেন, ‘এখানে খুব অল্প সময়েই একজন বেশি টাকা উপার্জন করতে পারে।’
বর্মা ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবের উত্তরের একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘টাকা রোজগার করাও প্রয়োজনীয়...পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।’
ইসরায়েলি গবেষকদের মতে, নির্মাণ শিল্পে কাজ করা ভারতীয়দের সংখ্যা এখনো যুদ্ধের আগে নির্মাণে নিযুক্ত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যার সমান নয়। শ্রমিক স্বল্পতা খাতটির সামগ্রিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করছে। ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এয়াল আর্গভ জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবরের আগে এই খাতে প্রায় ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি কর্মরত ছিলেন আর বিদেশি শ্রমিক ছিলেন প্রায় ২৬ হাজার।
আর্গভ জানান, বর্তমানে এই খাতে প্রায় ৩০ হাজার বিদেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। তবে এই সংখ্যা আগের মোট শ্রমশক্তির চেয়ে অনেক কম। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে নির্মাণ কার্যক্রম যুদ্ধের আগের স্তরের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম। তিনি বলেন, ‘এই সংখ্যা (ভারতীয়দের) এখনো খুব কম। যদিও এই অভাব বাসস্থানের ঘাটতি সৃষ্টি করছে না, তবে নতুন বাসস্থান সরবরাহে কিছু বিলম্ব ঘটাতে পারে।’ এ সময় তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের জনসংখ্যা বার্ষিক দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নির্মাণ খাতের এই বিলম্ব ভবিষ্যতে কিছু ঘাটতির কারণ হতে পারে।’