হোম > বিশ্ব > মধ্যপ্রাচ্য

ফেরাউনের বাণী খচিত নতুন প্রাসাদ নিয়ে বিতর্কে মিসরের সিসি

অনলাইন ডেস্ক

আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০: ৩০
মিসরের সিসির নতুন প্রাসাদ। ছবি: এএফপি

গত ১৯ ডিসেম্বর কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় ডেভেলপিং এইট (ডি–৮) গ্রুপের ১১ তম শীর্ষ সম্মেলন। এই সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসেবে তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল মিসর। অবশ্য ওই সম্মেলন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে আলোচিত হয়েছে মূলত সম্মেলনের বিলাসবহুল ভেন্যুর কারণে।

১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ডি–৮ গ্রুপে রয়েছে মিশর, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান এবং তুরস্ক। এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহমুদ আব্বাস এবং লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি।

সম্মেলনে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ‘মধ্যপ্রাচ্যের নজিরবিহীন সংকটগুলো’ সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন।

মিসরের নতুন পার্লামেন্ট ভবনের নিম্নকক্ষের ভেতরের দৃশ্য। ছবি: এএফপি

তবে শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনার বিষয়গুলো জনসাধারণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেনি। বরং, সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে সিসির নতুন বিলাসবহুল প্রাসাদ নিয়ে আলোচনা–সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।

কায়রোর পূর্বে মিসরের নতুন প্রশাসনিক রাজধানীতে অবস্থিত এই প্রাসাদ। চোখা ধাঁধানো এই প্রাসাদ নিয়ে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা এবং বিতর্ক। ৫০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এই প্রাসাদ ২৫ লাখ বর্গমিটার বিশাল এক কমপ্লেক্সের অংশ। ফেরাউনীয় শৈলীতে নির্মিত এই প্রাসাদে বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোর জন্য পিরামিড আকৃতির একটি বিশাল হল রয়েছে।

এই প্রাসাদের উদ্বোধন সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা সৃষ্টি করে। কিছু মিসরীয় এটিকে সিসির নেতৃত্বে এক অনন্য স্থাপত্য কৃতিত্ব হিসেবে প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে, অনেকে একে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। সমালোচকেরা মনে করেন, এই অর্থ শিক্ষা, হাসপাতাল এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে ব্যয় করা উচিত ছিল।

সমালোচকেরা প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সজ্জা নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন। অনেকের মতে, ইনডোর ডিজাইনে সিসির শাসনকেই মহিমান্বিত করা হয়েছে। একটি বিশেষ ম্যুরালে ২০১৩ সালে ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার ক্ষেত্রে সিসির ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রাসাদের বিভিন্ন দেয়ালে কোরআনের আয়াত শোভা পাচ্ছে। একটি আয়াতে ফেরাউনের একটি উক্তিও রাখা হয়েছে। বাণীটি এমন—আমি কি মিসরের রাজা নই, আর আমার পায়ের নিচ দিয়ে এই নদীগুলো প্রবাহিত হয় না?

দেয়ালে স্পষ্টাক্ষরে এই বাণী খোদাই করা হলেও সেখানে ফেরাউনের নাম–নিশানাও নেওয়া হয়নি!

উল্লেখ্য, কোরআনের ৪৩ নম্বর সুরা যুখরুফের ৫১ নম্বর আয়াতে ফেরাউনকে উদ্ধৃত করে এই বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।

নতুন প্রাসাদে হলরুমে লেখা ফেরাউনের বাণী। মেঝেতে দাঁড়ানো জেনারেল সিসি। ছবি: এক্স

অনেকে বলছেন, সিসি কি নিজেকে মিসরের আধুনিক ফেরাউন হিসেবে উপস্থাপন করতে চান? মিসরের যেই প্রাচীন রাজবংশ দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করেছে। সেই একচ্ছত্র শাসনদণ্ডের ইঙ্গিতই যেন প্রাসাদের দেয়ালে খোদাই করে স্মরণ করিয়ে দিতে চান সিসি!

সিসির নতুন প্রশাসনিক রাজধানী

কায়রো থেকে ৩০ মাইল পূর্বে বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে নতুন শহর গড়ে উঠছে। ইতিমধ্যেই এখানে আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু টাওয়ার এবং মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় গির্জা (ক্যাথেড্রাল) নির্মিত হয়েছে। এই শহরটি প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসির বেশ কয়েকটি বৃহৎ মেগা প্রকল্পের একটি।

২০১৬ সালে ‘নতুন প্রশাসনিক রাজধানী’ নির্মাণ শুরু হয়। প্রকল্পটি তদারকি করা কোম্পানি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যাপিটাল ফর আরবান ডেভেলপমেন্ট (এসিইউডি)–এর চেয়ারম্যান খালেদ আব্বাস জানান, প্রথম ধাপ প্রায় শেষের পথে এবং দ্বিতীয় ধাপ ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিকে শুরু হওয়ার কথা ছিল।

আফ্রিকার বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল বানিয়েছেন সিসি। ছবি: এএফপি

আব্বাসের মতে, ইতিমধ্যে ১ হাজার ৫০০–এর বেশি পরিবার এখানে বসবাস শুরু করেছে এবং এই সংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছাবে।

সরকারি মন্ত্রণালয়গুলো নতুন শহরে স্থানান্তরিত হওয়ায় ইতিমধ্যে প্রায় ৪৮ হাজার সরকারি কর্মচারী এখানে কাজ করছেন। তাঁদের অনেকেই পূর্ব কায়রো থেকে বিদ্যুৎ চালিত ট্রেনে যাতায়াত করছেন, যা ২০২৩ সালে চালু হয়।

নির্মাণ ব্যয়ের বিষয়ে আব্বাস জানান, প্রথম ধাপে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন মিসরীয় পাউন্ড (১০.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। পুরো প্রকল্পের ব্যয় আনুমানিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। সরকার জানিয়েছে, এসিইউডি এবং জমি বিক্রির আয় থেকে ব্যয় সংস্থান করা হবে।

সিসির নতুন প্রশাসনকি রাজধানী। ছবি: এএফপি

এসিইউডির ৫১ শতাংশ মালিকানা সেনাবাহিনীর এবং ৪৯ শতাংশের মালিক হাউজিং মন্ত্রণালয়। আব্বাস আরও জানান, দ্বিতীয় ধাপের ব্যয় হবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মিসরীয় পাউন্ড (৬.৪ বিলিয়ন ডলার)।

ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ

মিসরের অর্থনৈতিক দুরবস্থা অস্বীকার করার উপায় নেই। কাতারি সংবাদপত্র দ্য নিউ আরবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সিসি দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪৫ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালের জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২.৯ বিলিয়ন ডলারে। সাম্প্রতিক আঞ্চলিক সংঘাত, যেমন গাজার যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরে হুতিদের হামলা, মিসরের অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলেছে। বিশেষ করে সুয়েজ খাল থেকে আয় ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হয়েছে।

সিসির নতুন প্রাসাদ নিয়ে বিতর্ক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিরোধী শক্তি বিজয় লাভের পর বাশার আল আসাদের বিলাসবহুল প্রাসাদ দখলের ছবি ও ভিডিওগুলো আরব বিশ্বের ক্ষমতার এই প্রতীকগুলো নতুন করে সবার নজরে এসেছে। মিসরীয়দের জন্য এই প্রাসাদ তাদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের একটি চিত্র। সেই সঙ্গে এ দেশের নেতৃত্বের অগ্রাধিকার নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

তেহরান থেকে রাজধানী সরাতে চায় ইরান, লক্ষ্য কী

দুই পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা, হামাসের ইতিবাচক সাড়া

গাজায় নিহত ছাড়াল ৪৬ হাজার, প্রকৃত সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেশি বলছে গবেষণা