রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে হঠাৎ করে বিতর্ক, আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। তাঁর রাষ্ট্রপতি পদে থাকা না-থাকার প্রশ্নটি সামনে এসেছে। তাঁর বিরুদ্ধে শপথভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। তাঁর পদত্যাগ অথবা তাঁকে অপসারণের দাবি উঠেছে। তবে তাঁকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর মনে করলেও তাঁর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কারও কারও মধ্যে একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রাষ্ট্রপতি নিয়ে ঐকমত্যের অভাব আছে বলে মনে হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না। দলটি মনে করছে, রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই—সম্প্রতি একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথভঙ্গের অভিযোগ তুলে তিনি পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন। তা ছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি তোলে। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ২২ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়। ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন নামের সংগঠনের ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করা হয়। এমনকি একপর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টাও হয়। তবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। বঙ্গভবন ঘিরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভের বিষয়ে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ২৩ অক্টোবর বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থান আপনারা দেখেছেন, আমরা বলেছি তাঁরা (বিক্ষোভকারীরা) যেন বঙ্গভবনের পাশ থেকে সরে যান। বঙ্গভবনের আশপাশে নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে।’
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবির ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বলছি কোনো অগ্রগতি হলে আপনারা জানবেন।’ তখন সাংবাদিকেরা আবারও জানতে চান, ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, এই তো?’ জবাবে প্রেস সচিব বলেন, ‘হ্যাঁ।’
রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনার মধ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের তিনজন নেতা গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন। এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে দেশে কোনো ধরনের সাংবিধানিক জটিলতা বা অস্থিরতা তৈরি হোক, দলটি তা চায় না।
বিএনপি মনে করে, দেশ ছেড়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি করেননি—সেটা জনগণের দেখার বিষয় নয়। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তিনি দেশ ছেড়েছেন, এটাই বাস্তবতা। তাঁর দেশত্যাগের পর কেউ দালিলিক প্রমাণ নিয়ে এত দিন প্রশ্ন তোলেনি। অথবা যাঁরা তাঁকে দেশ ছাড়তে সাহায্য করেছেন, তাঁরাও এ বিষয় নিয়ে কথা বলেননি; বরং এত দিন পর বিষয়টি নিয়ে কথা তোলার পেছনে কোনো ‘রহস্য’ বা ‘ষড়যন্ত্র’ আছে কি না, সে বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা বরং বেশি সতর্ক।
দলটির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে তাঁদের মূল লক্ষ্য নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলো দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করে দেশকে নির্বাচনের পথে নেওয়া। রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে যেকোনো ধরনের জটিলতা নির্বাচনী পথ আরও দীর্ঘায়িত করবে বলে তাঁরা মনে করেন।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সে সময় বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রপতিকে রেখেই সরকার গঠন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের যদি মনে হয়, এই সেটআপে অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে অথবা জনগণ এই সেটআপে অসন্তুষ্ট, তাহলে এই সেটআপ নিয়ে আমরা ভাবব।’
নাহিদ ইসলাম আরও বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং এর মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত আসবে। তবে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সতর্ক অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। সব দল এ ব্যাপারে এক রকম কথা বলছে তা নয়। সে জন্যই রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে যে সংকট তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। তাঁকে রাখা এবং না-রাখা দুটোই সমস্যা তৈরি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে রেখে যে স্বস্তিবোধ করছে না, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু তাঁকে সরানোর সহজ উপায়ও হাতের কাছে নেই। দুই উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে দেখা করে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি নাকি তাতে সম্মত হননি। এখন একদিকে রাষ্ট্রপতি পদে নতুন মুখ এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দেওয়ার একটি উত্তম উপায় অনুসন্ধান চলছে বলে শোনা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের জন্য ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হয়, এমন কিছু হতে দিতে অনিচ্ছুক বর্তমান সরকার। কিন্তু অসাবধানতাবশত তেমন সুড়ঙ্গ তৈরি হওয়ার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে। ছাত্রদের মাঠে নামিয়ে দাবি আদায়ের কৌশল একসময় বুমেরাং হতে পারে বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় সবার চোখ যখন বঙ্গভবনের দিকে, তখন আকস্মিকভাবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা কতটুকু সুবিবেচনাপ্রসূত হয়েছে, সে প্রশ্নও উঠছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ আরও কিছু সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার ফলে শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্রলীগের নাম মুছে যাবে, নাকি অন্য রূপে ফিরে আসবে—সে প্রশ্ন আছে। কোনো সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হলেই সমাজ বা প্রতিষ্ঠান থেকে সেই সংগঠনের প্রভাব মুছে ফেলা যে সম্ভব নয়, তা অতীতে অনেক ঘটনা থেকে বোঝা গেছে। জামায়াত-শিবির এবং আরও কয়েকটি উগ্রবাদী সংগঠন নিষিদ্ধ করে কি তাদের অস্তিত্বহীন করা সম্ভব হয়েছে?
বর্তমান ক্ষমতাসীন এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিষয়ে খুবই সেনসেটিভ। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জীবন থাকতে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে বলি একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল। এখন প্রশ্ন আসে, ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক কাঠামোতে কীভাবে রাজনীতি করতে পারে? যদি আওয়ামী লীগ ফিরে আসে, তাহলে গণ-অভ্যুত্থান ও শহীদদের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। আমাদের জীবন থাকতে তা হতে দেওয়া হবে না।’
নাহিদ ইসলাম জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের একজন নেতা, সংগঠক। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান নিয়ে তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র চলে রাজনৈতিক নীতির ভিত্তিতে, আবেগ সব সময় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যে দুঃশাসন-অপশাসনের ভিত্তি তৈরি করেছিল, তা গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে কি আওয়ামী লীগকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যাবে? অন্তর্বর্তী সরকার যদি আওয়ামী লীগের চেয়ে উন্নত শাসন উপহার দিতে না পারে, তাহলে কি আওয়ামী লীগের ফিরে আসা ঠেকানো যাবে? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে না পারলে মানুষ তো বলবে, আওয়ামী শাসনামলই ভালো ছিল।
যারা অপরাধ সংঘটিত করেছে, ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা দিতে হবে, শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে কি মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা যাবে?
আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে হটানো অবশ্যই একটি বড় অর্জন। আওয়ামী লীগ বিরুদ্ধ মত ও পথের দলনে কঠোর ছিল। স্বজন তোষণের রাজনীতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রশাসনকে দলীয়করণ করে রাজনীতিকে যে বৃত্তের মধ্যে বন্দী করেছিল, তা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ রচনা করাই তো বর্তমান সরকারের বড় কাজ। মানুষ কাজ দেখতে চায়। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ভারসাম্য তৈরির পথ না দেখিয়ে শুধু আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভীতি ছড়িয়ে বেশি দূর আগানো যাবে বলে মনে হয় না।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা