সাধারণত অভিষেক ভাষণে নির্বাচনী রাজনীতিকে ছাড়িয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার করার কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে সেই রেওয়াজে ছেদ ঘটালেন। তাঁর অভিষেকের ভাষণে তেমন কোনো ঐক্যের সুর ছিল না। তবে ট্রাম্প সাম্প্রতিক রেওয়াজ ভাঙলেও ফিরিয়ে এনেছেন বহু পুরোনো ঐতিহ্য।
পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সমালোচনা বাদে উদ্বোধনী ভাষণে আর মাত্র একজন প্রেসিডেন্টের নাম নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি উইলিয়াম ম্যাককিনলি, যিনি ট্রাম্পের ভাষায় ‘এক মহান প্রেসিডেন্ট’। যদিও তিনি এমন এক প্রেসিডেন্ট, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভে স্থান দিতে চান না বহু আমেরিকান। তাঁর নামে ছিল একটি পর্বতশ্রেণি, যেটা পরে পাল্টে দিয়ে আলাস্কার স্থানীয় কোকুন ভাষায় মাউন্ট ডেনালি নাম রাখেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
এই নাম পরিবর্তনকে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ হিসেবে দেখেন ট্রাম্প। তাঁর মতে, এটি বামপন্থী ভাবাদর্শের প্রভাব। তাই তিনি মাউন্ট ডেনালির নাম পরিবর্তন করেন। তবে শুধু এটুকুতে থামবেন না ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার অর্জনগুলোকেও বাতিল করবেন তিনি।
ম্যাককিনলির প্রতি ট্রাম্পের স্তুতি ও শ্রদ্ধা জানানোর বিশেষ কারণ আছে। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়া উইলিয়াম ম্যাককিনলির আমলেই পানামা খাল নিয়ে দেনদরবার শুরু হয় এবং এর কাজ শুরু হয়। ম্যাককিনলিও শুল্কপাগল ছিলেন। আমেরিকার গিল্ডেড এজ বা সোনায় মোড়ানো যুগের (১৮৭০-৯০ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ব্যাপক শিল্পায়নের সময়কালকে গিল্ডেড এজ বলা হয় এবং সে সময়কার শিল্পপতিদের, যাঁরা ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন ব্যাপকভাবে, তাঁদের রবার ব্যারন বা ডাকু ব্যারন বলা হতো) ডাকু ব্যারনদের সমর্থন পেয়েছিলেন।
পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্পের এক বিশেষ ধারণা আছে। তিনি মনে করেন, যে চুক্তি অনুসারে খালটি পানামার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল, তার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে এবং এটি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তবে এই ইস্যুতে ট্রাম্পের বক্তৃতায় সবচেয়ে বেশি নজরকাড়া অংশ ছিল, প্রয়োজন হলে ‘আমরা এটি ফিরিয়ে নেব।’
পানামা খালের মালিকানা পানামার কাছে হস্তান্তরের চুক্তি ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে স্বাক্ষরিত হয়। তখন এটি রক্ষণশীলদের কাছে দেশপ্রেমহীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সে সময় এই কাজকে বোকা লিবারেলদের কাজ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্পও ঠিক একই রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করেন। পানামা খালকে যে বছর হস্তান্তর করা হয়, তার ঠিক ১০ বছর পরে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৮২তম এয়ারবর্ন ডিভিশন অভিযান চালায় এবং শত শত মানুষকে হত্যা করে। তখন ট্রাম্পের বয়স ৪০-এর কোঠায়। ফলে ট্রাম্প এখন যখন এই বক্তব্য দেন, তখন তা আসলে আমেরিকানদের কাছে ভালো শোনালেও পানামাবাসীর জন্য খুবই ভীতিকর শোনায়।
এখন যে ভূখণ্ড সম্প্রসারণের কথা বলা হচ্ছে, তা এমন একটি বিষয়, যা গত এক শতাব্দীতে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টই সেই অর্থে অনুসরণ করেননি। যিনি আমেরিকার আবাদি ভূখণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছিলেন, তিনি হলেন উইলিয়াম ম্যাককিনলি। তাঁর প্রথম মেয়াদে কিউবা, হাওয়াই এবং ফিলিপাইনসহ কিছু ভূখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনকে নিজেদের ভূখণ্ড করে নেয়। সে সময় ম্যাককিনলি বলেছিলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি ফিলিপাইন চাইনি। তবে সেগুলো যখন আমাদের কাছে ঈশ্বরের উপহার হিসেবে এল, তখন আমি জানতাম না কী করতে হবে।’ তবে ট্রাম্পের জন্য ভূখণ্ড সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। (তিনি মনে করেন, এটি দেশের কাঙ্ক্ষিত পরিপূর্ণতা হবে, যদি আমেরিকা মঙ্গলে তার পতাকা স্থাপন করতে পারে।) তিনি আমেরিকাকে ‘পুনরায় একটি বর্ধনশীল জাতি’ হিসেবে দেখতে চান।
বর্তমানে আমেরিকার সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতি চ্যালেঞ্জগুলো হলো চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা এবং রাশিয়ার ইউক্রেন দখল, পানামা খাল হয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের যাতায়াত ফি পরিশোধ নয়। ভাষণে, ট্রাম্প চীনের কথা শুধু খাল প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যকে তিনি টেনেছেন জিম্মি মুক্তি নিয়ে একধরনের আত্মতৃপ্তির আলোচনা প্রসঙ্গে।
ইউক্রেনের কথা তিনি একবারও উল্লেখ করেননি। শুধু এটুকু বলেছেন, আমেরিকা ‘বিপুল অর্থ’ দিয়ে বিদেশিদের সীমান্ত রক্ষা করছে, অথচ নিজের সীমান্ত রক্ষায় ব্যর্থ। তবে ট্রাম্প পানামা খাল ‘পুনরুদ্ধার’ বলতে কী বোঝাতে চান, তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি নিজেই পানামায় কম টোল ফি নেওয়ার জন্য রাজি হবেন? ট্রাম্প সরল ভাষায় কথা বলার জন্য পরিচিত, কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান অস্পষ্ট।
শুল্কনীতির ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ম্যাককিনলির সঙ্গে মিলে যায়। ২৫তম প্রেসিডেন্ট ম্যাককিনলি ১৮৯৭ সালে ডিঙলি অ্যাক্টে সই করেছিলেন, যার মাধ্যমে শুল্কহার ৫০ শতাংশের ওপর চলে যায়। অভিষেক বক্তৃতায় ম্যাককিনলি বলেছিলেন, এটি মার্কিন উৎপাদকদের জন্য ঘরোয়া বাজার রক্ষা করার লক্ষ্যে করা হয়েছিল। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দেওয়া এক ভাষণে ম্যাককিনলি বলেছিলেন, কর বাড়ানো ছাড়াই সরকারের আয় বৃদ্ধির এক বিচক্ষণ পদক্ষেপ এটি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও একই ভাবনার মানুষ। তিনি বলেন, ‘আমরা অন্যান্য দেশের ওপর শুল্ক এবং কর আরোপ করব আমাদের নাগরিকদের ধনী করার জন্য। এটি হবে বিশাল পরিমাণ অর্থ, যা বিদেশি উৎস থেকে আমাদের কোষাগারে প্রবেশ করবে।’ তবে এটি এখনো স্পষ্ট নয় যে, ট্রাম্প আসলে কী করবেন।
আততায়ীর হাতে ম্যাককিনলি নিহত হওয়ার পর তাঁর শুল্ক বৃদ্ধির নীতি বিরোধী ডেমোক্র্যাটরাও বজায় রাখে। ম্যাককিনলি তাঁর শাসনামলে বড় বড় ব্যবসাগুলোকে প্রাধান্য ও সুবিধা দিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে অনেকে ম্যাককিনলির নীতিকে মনে করেন, পুঁজিপতিদের সুরক্ষার বামঘেঁষা নীতি হিসেবে। সেই একই ধারা ফিরিয়ে এনেছেন ট্রাম্প। ম্যাককিনলির নির্বাচনের সময় অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান আড়াই লাখ ডলার দিয়েছিল। একই পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল জ্বালানি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল।
বিপরীতে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ঢেলেছেন ইলন মাস্ক। ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ জুগিয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস এবং অন্যরা। শপথগ্রহণের পরপরই ট্রাম্প এক নতুন ‘সোনালি যুগের’ আগমনী বার্তা ঘোষণা করেন। তবে শুল্ক, আঞ্চলিক সম্প্রসারণ এবং পানামা-গ্রিনল্যান্ডের প্রতি তাঁর আগ্রহ মূলত ম্যাককিনলির আমলের সেই পুরোনো ‘গিল্ডেড’ যুগের পুনরাগমন।