অনলাইন ডেস্ক
বহু বছর ধরেই বৈশ্বিক বস্ত্র শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে চীন। তবে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিমুখ পরিবর্তন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন রূপ নেওয়ায় দেশটির এই অবস্থান শিগগির টলে যেতে পারে। সম্প্রতি চীনের একটি উন্নয়ন ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক নেতাদের আকৃষ্ট করার প্রচুর প্রচেষ্টা চালানো হলেও, ভেতরের চিত্রটা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়।
গত মাসে ওয়াশিংটন চীনা পণ্যের ওপর নজিরবিহীন ১০ শতাংশ হারে সাধারণ শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে সামগ্রিক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এর ফলে, বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতি এক সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তবে এতে উত্তেজিত না হয়ে, চীনও দ্রুত মার্কিন রপ্তানির ওপর ২১ বিলিয়ন ডলারের পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেছে। এই শুল্কারোপের ক্ষেত্রে কৃষি, প্রযুক্তি এবং গাড়ির মতো রাজনৈতিক সংবেদনশীল খাতকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পাল্টাপাল্টি শুল্কের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত নীতিগত পরিবর্তন পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে চীন থেকে সরে আসতে প্ররোচিত করেছে। এর কারণ শুধু খরচ নয়, বরং ভূ–রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানোও। তৈরি পোশাক ও ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড স্টিভ ম্যাডেন এরই মধ্যে চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ক্যালভিন ক্লেইন ও টমি হিলফিগারের মালিক প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ করপোরেশনও একই পথে হাঁটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেইজিংয়ের আধিপত্য যখন কমছে, তখন এক নতুন খেলোয়াড় নীরবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সাশ্রয়ী, কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এবং এরই মধ্যেই বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পে এক প্রধান শক্তি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ নীরবে বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম বস্ত্র সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ এখন একটি সুস্পষ্ট ব্যয় সুবিধা (যখন কোনো উৎপাদক তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে কম খরচে উৎপাদন পরিচালনা করতে পারে তখন তাকে কস্ট অ্যাডভান্টেজেস বা ব্যয় সুবিধা বলা হয়) ভোগ করছে, যেখানে স্ট্যান্ডার্ড ডিউটি বা সাধারণ শুল্ক (সাধারণভাবে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশগুলো যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করে তাকেই স্ট্যান্ডার্ড ডিউটি বলে) মাত্র ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী খুচরা বিক্রেতারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের সরবরাহ চেইনকে বহুমুখী করতে চাচ্ছে, তাই প্রধান ব্র্যান্ডগুলো ক্রমেই বিকল্প কেন্দ্রে তাদের ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছে। এর ফলে, মার্কিন পোশাক আমদানিতে চীনের হিস্যা ধীরে ধীরে কমছে। বিপরীতে বাংলাদেশের হিস্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ৭–৮ শতাংশের জোগানদাতা।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দেশের প্রবৃদ্ধি বিশেষ করে প্রধান বাজারগুলোতে উল্লেখযোগ্য—২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক আমদানি ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও এটি একটি দারুণ রেকর্ড! ইউরোপীয় ইউনিয়নেও রপ্তানি বছরওয়ারি হিসাবে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে, যা এই অঞ্চলে চীনের দুর্বল প্রবৃদ্ধিকে বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে।
কোভিড–১৯ মহামারি এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। কারখানা বন্ধ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি ৩১ শতাংশ কমলেও, বাংলাদেশ দ্রুত প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও কর্মসংস্থান ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। বাংলাদেশ দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। এই দ্রুত অভিযোজন বাংলাদেশকে ‘ফ্রেন্ডশোরিং’ (ফ্রেন্ডশোরিং মানে হলো উৎপাদন বা সরবরাহ চেইনকে বন্ধুভাবাপন্ন ও স্থিতিশীল দেশে সরিয়ে নেওয়া, যাতে ভূ–রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানো যায়)—এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
এইচঅ্যান্ডএম, জারা, ওয়ালমার্ট ও টার্গেটের মতো মতো ফাস্ট ফ্যাশন জায়ান্টরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মার্কিন ব্র্যান্ডও নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সুইডিশ খুচরা বিক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম প্রায় ১ হাজারটি বাংলাদেশি কারখানা থেকে পণ্য কিনে থাকে। আর স্পেনের জারার মূল পণ্য সরবরাহকারী দেশই হলো বাংলাদেশ।
কেবল তাই নয়, চীনা কোম্পানিগুলোও শুল্ক এড়াতে এবং এর বাণিজ্য সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই বিষয়টি দারুণ এক সহাবস্থান তৈরি করছে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের একটি স্বাভাবিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরে সেখানকার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব উপায়ে বস্ত্র উৎপাদনে অগ্রগামী দেশ হিসেবে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে ২২৯টি কারখানা এলইইডি বা লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সনদধারী। এই এলইইডি হলো একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব ভবন নিশ্চিতকরণ সনদ। এর ফলে জ্বালানি দক্ষতা, পানি ব্যবহার কমানো ও অপচয় রোধ এবং বর্জ্য কমানোর মতো বিষয়গুলো শিল্প জুড়ে অগ্রাধিকার পায়। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলো তাদের সরবরাহ চেইনকে পরিবেশবান্ধব রাখার জন্য যেখানে অর্থ ব্যয় করেও ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন, সেখানে বাংলাদেশ এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে দারুণভাবে এগিয়ে এসেছে।
অটোমেশন এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে। দেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি কারখানা ২০২৫ সালের মধ্যে উন্নত যন্ত্রপাতি সংযোজনের পরিকল্পনা করেছে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং গুণমান উন্নত করবে। সিনথেটিক ফাইবার টেক্সটাইল, ডিজিটাল মজুরি পরিশোধ ব্যবস্থা এবং কারখানা আধুনিকীকরণের দিকে এই পরিবর্তন দেশটির মূল্য শৃঙ্খলে আরোহণের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
সরকার সমর্থিত এই প্রচেষ্টাগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে মিলে এমন এক সময়ে বিকশিত হচ্ছে যখন তৈরি পোশাক শিল্পের অন্য দেশগুলো এই জায়গাতে বলা যায় খাবিই খাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা জোরদার করে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। কারণ, রিটেইল ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি ভোক্তা ও অংশীজনেরা সর্বোচ্চ মানের সঙ্গে ব্যয় দক্ষতা খুঁজছেন। আর বাংলাদেশ এই চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে অবস্থান করছে।
এর ফলাফল স্পষ্টতই দৃশ্যমান। ভার্টিক্যাল ম্যাটেরিয়াল ইন্টিগ্রেশন (ভার্টিক্যাল ম্যাটেরিয়াল ইন্টিগ্রেশন—হলো কাঁচামাল থেকে শুরু করে তৈরি পণ্য পর্যন্ত একাধিক উৎপাদন ধাপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা), অটোমেশন এবং চীনের কাছে সহজলভ্য নয় এমন বাণিজ্য সুবিধার কারণে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
তবে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের কারণে কাঁচামাল পরিবহনে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। যার ফলে, উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব হতে পারে। এই লজিস্টিক জটিলতা দ্রুত বাজারে পণ্য সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া ব্র্যান্ডগুলোর জন্য অসুবিধা তৈরি করতে পারে, তবে তরুণ প্রজন্ম আরও টেকসই বিকল্পের জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছুকও হতে পারে।
বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, তবে দেশটি কেবল পরিবর্তিত বাণিজ্য কাঠামোর সুবিধাভোগী হিসেবেই নয়, তৈরি পোশাক শিল্পের একটি প্রভাবশালী অংশীদার হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে। স্বল্পমেয়াদি লাভকে দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্বে রূপান্তরিত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র–চীন শুল্ক যুদ্ধের সুবিধা পেলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করবে পাল্টাপাল্টি এই শুল্ক মোকাবিলা এবং নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য সুবিধাগুলো ব্যবহারের সক্ষমতার ওপর। ইউরোপীয় বাজারে অব্যাহত অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা সম্প্রসারণ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস প্লাস (জিএসপি+) স্কিমে উত্তরণের প্রচেষ্টা চলছে।
তবুও, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা যখন বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর তাঁদের নজরদারি দ্বিগুণ করছেন, তখন বাংলাদেশকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। যদি বাংলাদেশ নিজেকে চীনের টেকসই, নির্ভরযোগ্য এবং মানসম্পন্ন বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা থেকে আরও বড় আকারে সদর্পে মাথা তুলতে পারবে।
নিবন্ধটির লেখক: ড. ম্যাথিউ পাজারেস জংসন। তিনি ক্যারিবিয়ান আসিয়ান কাউন্সিলের প্রতিনিধি কাউন্সিলর এবং জাতিসংঘ স্বীকৃত সংস্থা ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান–সাউথইস্ট এশিয়া চেম্বারের কূটনৈতিক দূত।
মডার্ন ডিপ্লোমেসিতে প্রকাশিত নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক আব্দুর রহমান
বহু বছর ধরেই বৈশ্বিক বস্ত্র শিল্পে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে চীন। তবে, বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিমুখ পরিবর্তন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং ভূ–রাজনৈতিক উত্তেজনা নতুন রূপ নেওয়ায় দেশটির এই অবস্থান শিগগির টলে যেতে পারে। সম্প্রতি চীনের একটি উন্নয়ন ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক নেতাদের আকৃষ্ট করার প্রচুর প্রচেষ্টা চালানো হলেও, ভেতরের চিত্রটা ততটা আশাব্যঞ্জক নয়।
গত মাসে ওয়াশিংটন চীনা পণ্যের ওপর নজিরবিহীন ১০ শতাংশ হারে সাধারণ শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে সামগ্রিক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এর ফলে, বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনীতি এক সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তবে এতে উত্তেজিত না হয়ে, চীনও দ্রুত মার্কিন রপ্তানির ওপর ২১ বিলিয়ন ডলারের পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেছে। এই শুল্কারোপের ক্ষেত্রে কৃষি, প্রযুক্তি এবং গাড়ির মতো রাজনৈতিক সংবেদনশীল খাতকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ বা পাল্টাপাল্টি শুল্কের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত নীতিগত পরিবর্তন পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান পোশাক ব্র্যান্ডগুলোকে চীন থেকে সরে আসতে প্ররোচিত করেছে। এর কারণ শুধু খরচ নয়, বরং ভূ–রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানোও। তৈরি পোশাক ও ফুটওয়্যার ব্র্যান্ড স্টিভ ম্যাডেন এরই মধ্যে চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ক্যালভিন ক্লেইন ও টমি হিলফিগারের মালিক প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ করপোরেশনও একই পথে হাঁটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেইজিংয়ের আধিপত্য যখন কমছে, তখন এক নতুন খেলোয়াড় নীরবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সাশ্রয়ী, কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এবং এরই মধ্যেই বিশ্বব্যাপী পোশাক শিল্পে এক প্রধান শক্তি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ নীরবে বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম বস্ত্র সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ এখন একটি সুস্পষ্ট ব্যয় সুবিধা (যখন কোনো উৎপাদক তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে কম খরচে উৎপাদন পরিচালনা করতে পারে তখন তাকে কস্ট অ্যাডভান্টেজেস বা ব্যয় সুবিধা বলা হয়) ভোগ করছে, যেখানে স্ট্যান্ডার্ড ডিউটি বা সাধারণ শুল্ক (সাধারণভাবে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশগুলো যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করে তাকেই স্ট্যান্ডার্ড ডিউটি বলে) মাত্র ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী খুচরা বিক্রেতারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের সরবরাহ চেইনকে বহুমুখী করতে চাচ্ছে, তাই প্রধান ব্র্যান্ডগুলো ক্রমেই বিকল্প কেন্দ্রে তাদের ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করছে। এর ফলে, মার্কিন পোশাক আমদানিতে চীনের হিস্যা ধীরে ধীরে কমছে। বিপরীতে বাংলাদেশের হিস্যা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ৭–৮ শতাংশের জোগানদাতা।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গত বছর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। দেশের প্রবৃদ্ধি বিশেষ করে প্রধান বাজারগুলোতে উল্লেখযোগ্য—২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক আমদানি ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও এটি একটি দারুণ রেকর্ড! ইউরোপীয় ইউনিয়নেও রপ্তানি বছরওয়ারি হিসাবে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে, যা এই অঞ্চলে চীনের দুর্বল প্রবৃদ্ধিকে বহুলাংশে ছাড়িয়ে গেছে।
কোভিড–১৯ মহামারি এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। কারখানা বন্ধ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাতের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানি ৩১ শতাংশ কমলেও, বাংলাদেশ দ্রুত প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও কর্মসংস্থান ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। বাংলাদেশ দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) উৎপাদনে মনোযোগ দেয়। এই দ্রুত অভিযোজন বাংলাদেশকে ‘ফ্রেন্ডশোরিং’ (ফ্রেন্ডশোরিং মানে হলো উৎপাদন বা সরবরাহ চেইনকে বন্ধুভাবাপন্ন ও স্থিতিশীল দেশে সরিয়ে নেওয়া, যাতে ভূ–রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানো যায়)—এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
এইচঅ্যান্ডএম, জারা, ওয়ালমার্ট ও টার্গেটের মতো মতো ফাস্ট ফ্যাশন জায়ান্টরা এরই মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মার্কিন ব্র্যান্ডও নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সুইডিশ খুচরা বিক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম প্রায় ১ হাজারটি বাংলাদেশি কারখানা থেকে পণ্য কিনে থাকে। আর স্পেনের জারার মূল পণ্য সরবরাহকারী দেশই হলো বাংলাদেশ।
কেবল তাই নয়, চীনা কোম্পানিগুলোও শুল্ক এড়াতে এবং এর বাণিজ্য সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই বিষয়টি দারুণ এক সহাবস্থান তৈরি করছে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের একটি স্বাভাবিক হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরে সেখানকার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছেন।
এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব উপায়ে বস্ত্র উৎপাদনে অগ্রগামী দেশ হিসেবে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে ২২৯টি কারখানা এলইইডি বা লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন সনদধারী। এই এলইইডি হলো একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব ভবন নিশ্চিতকরণ সনদ। এর ফলে জ্বালানি দক্ষতা, পানি ব্যবহার কমানো ও অপচয় রোধ এবং বর্জ্য কমানোর মতো বিষয়গুলো শিল্প জুড়ে অগ্রাধিকার পায়। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলো তাদের সরবরাহ চেইনকে পরিবেশবান্ধব রাখার জন্য যেখানে অর্থ ব্যয় করেও ক্রমবর্ধমান চাপের সম্মুখীন, সেখানে বাংলাদেশ এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে দারুণভাবে এগিয়ে এসেছে।
অটোমেশন এবং প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে। দেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি কারখানা ২০২৫ সালের মধ্যে উন্নত যন্ত্রপাতি সংযোজনের পরিকল্পনা করেছে, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং গুণমান উন্নত করবে। সিনথেটিক ফাইবার টেক্সটাইল, ডিজিটাল মজুরি পরিশোধ ব্যবস্থা এবং কারখানা আধুনিকীকরণের দিকে এই পরিবর্তন দেশটির মূল্য শৃঙ্খলে আরোহণের আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে।
সরকার সমর্থিত এই প্রচেষ্টাগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে মিলে এমন এক সময়ে বিকশিত হচ্ছে যখন তৈরি পোশাক শিল্পের অন্য দেশগুলো এই জায়গাতে বলা যায় খাবিই খাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা জোরদার করে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। কারণ, রিটেইল ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি ভোক্তা ও অংশীজনেরা সর্বোচ্চ মানের সঙ্গে ব্যয় দক্ষতা খুঁজছেন। আর বাংলাদেশ এই চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে অবস্থান করছে।
এর ফলাফল স্পষ্টতই দৃশ্যমান। ভার্টিক্যাল ম্যাটেরিয়াল ইন্টিগ্রেশন (ভার্টিক্যাল ম্যাটেরিয়াল ইন্টিগ্রেশন—হলো কাঁচামাল থেকে শুরু করে তৈরি পণ্য পর্যন্ত একাধিক উৎপাদন ধাপ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা), অটোমেশন এবং চীনের কাছে সহজলভ্য নয় এমন বাণিজ্য সুবিধার কারণে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
তবে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। ভার্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের কারণে কাঁচামাল পরিবহনে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। যার ফলে, উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহে বিলম্ব হতে পারে। এই লজিস্টিক জটিলতা দ্রুত বাজারে পণ্য সরবরাহে অগ্রাধিকার দেওয়া ব্র্যান্ডগুলোর জন্য অসুবিধা তৈরি করতে পারে, তবে তরুণ প্রজন্ম আরও টেকসই বিকল্পের জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছুকও হতে পারে।
বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, তবে দেশটি কেবল পরিবর্তিত বাণিজ্য কাঠামোর সুবিধাভোগী হিসেবেই নয়, তৈরি পোশাক শিল্পের একটি প্রভাবশালী অংশীদার হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারবে। স্বল্পমেয়াদি লাভকে দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্বে রূপান্তরিত করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র–চীন শুল্ক যুদ্ধের সুবিধা পেলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করবে পাল্টাপাল্টি এই শুল্ক মোকাবিলা এবং নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য সুবিধাগুলো ব্যবহারের সক্ষমতার ওপর। ইউরোপীয় বাজারে অব্যাহত অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা সম্প্রসারণ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস প্লাস (জিএসপি+) স্কিমে উত্তরণের প্রচেষ্টা চলছে।
তবুও, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকেরা যখন বিশ্ব বাণিজ্যের ওপর তাঁদের নজরদারি দ্বিগুণ করছেন, তখন বাংলাদেশকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। যদি বাংলাদেশ নিজেকে চীনের টেকসই, নির্ভরযোগ্য এবং মানসম্পন্ন বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা থেকে আরও বড় আকারে সদর্পে মাথা তুলতে পারবে।
নিবন্ধটির লেখক: ড. ম্যাথিউ পাজারেস জংসন। তিনি ক্যারিবিয়ান আসিয়ান কাউন্সিলের প্রতিনিধি কাউন্সিলর এবং জাতিসংঘ স্বীকৃত সংস্থা ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান–সাউথইস্ট এশিয়া চেম্বারের কূটনৈতিক দূত।
মডার্ন ডিপ্লোমেসিতে প্রকাশিত নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক আব্দুর রহমান
বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো ছোট দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সমন্বয়ে জোর দিতে দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সমন্বয় বলতে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থনীতিতে পরিবর্তন বা সমন্বয় আনার চেষ্টাকে বোঝানো হচ্ছে।
১ দিন আগেআরব দেশগুলোর ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে আপাত-নীরবতা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং ঐতিহাসিক কারণ। স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের দাবি এবং বাসিন্দাদের ওপর এই দীর্ঘ নিপীড়ন নিয়ে যে আরব দেশগুলো কিছুই করছে না, বা নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকছে—এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়।
২ দিন আগেপ্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। চলুন দেখি, এই দুই রাজার যুদ্ধে কার প্রাণ যায়! ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্কের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজ দেশে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যে ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আর
৩ দিন আগেদখলকৃত অর্থনীতিতে প্রতিভা এবং সাফল্যের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই এমন দক্ষ কর্মীরা দেশ ছেড়ে চলে যান এবং সক্ষম সংস্থাগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভালো যোগাযোগ আছে এমন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবন বা মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াই (বা কখনো কখনো পণ্য সরবরাহ না করেও)
৩ দিন আগে