১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুযায়ী মজুরি।
১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের উন্মুক্ত উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এর মধ্যে কোনো ঘোরানো-ফেরানো কথার সুযোগ নেই। শাসনতন্ত্রে আমরা চারটি নীতিকে মেনে নিয়েছি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ...আমি যা মনে করি, আলজিয়ার্স কনফারেন্সে যেটা আমি বলেছিলাম, দুনিয়া আজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
একটি শোষক, আরেকটি শোষিত। শোষিতের পক্ষে যারা থাকে, আর শোষকের পক্ষে যারা থাকে—তারা কে, তারা কারা, সে কথা দুনিয়ার মানুষ জানে।...সমাজতন্ত্র আমাদের প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র না হলে এ দেশের দুঃখী মানুষের বাঁচবার উপায় নাই। আমরা শোষণহীন সমাজতন্ত্র চাই।...সমাজতন্ত্রের রাস্তা সোজা নয়। সমাজতন্ত্র করতে হলে যে ক্যাডারের দরকার, তা আমরা করতে পেরেছি কি না, এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। ...সমাজতন্ত্রের রাস্তায় আমরা যে পদক্ষেপ নিয়েছি, তা থেকে আমরা পিছু হটতে পারি না, পারব না, যত বড় ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন।’
বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়নি ঠিকই; কিন্তু সমাজতন্ত্র অভিমুখী যে যাত্রা, সেটি আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধের মধ্যে ছিল এবং আমরা আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন সমাজতন্ত্র কোথায় চলে গেছে এর কোনো ঠিক নেই। সেই জায়গায় লুটপাটতন্ত্রীরাই বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলছে। কাজেই সেই লুটপাটতন্ত্রীদের হাত থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে না পারি; তাহলে আমাদের স্বাধীনতার প্রাপ্তি সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা বলেও বলতে হয় অপ্রাপ্তি আমাদের অনেক বেশি।
কাজেই আজকে স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে আমাদের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে; যা আমরা হারিয়েছি, সেই হারানো সম্পদ আমাদের ফিরে পেতে হবে। আমাদের স্বাধীনতার প্রকৃত যে মূল চার নীতি, তা প্রকৃত অর্থেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা যদি আমরা করতে পারি; তাহলেই সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর কথা ধরেই বলি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’—স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ী হলেও আমরা যে মুক্তির সংগ্রামে অনেক পিছিয়ে পড়েছি, এই বেদনাদায়ক সত্যটি স্বীকার না করে পারা যায় না। আজকে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হব। আমাদের সেই হারানো মূল্যবোধগুলো ফিরে পাব।
সত্যিকার অর্থেই যে মুক্তি, সেটি আমরা অর্জন করব। এই মুক্তির লক্ষ্যে সংগঠিত হওয়ার জন্য আমি বলি প্রকৃত প্রস্তাবে সেই যে চারটি মূলনীতি; যার ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের প্রথম অসাধারণ সংবিধানটি রচনা করেছিলাম; যে সংবিধান রচনা হয়েছিল কালি দিয়ে নয়, অজস্র শহীদের রক্তে, সেই সংবিধানটিকে যথার্থ অর্থে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সমাজতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে বা এড়িয়ে গিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ বাতলায় যারা, কিংবা যারা বলে সমাজতন্ত্র একালের জন্য একটি অকার্যকর মতবাদ, নিঃসন্দেহে তারা সাম্রাজ্যবাদেরই তল্পিবাহক। সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই তো আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। অথচ মুক্তির সংগ্রাম যে এখনো শেষ হয়নি, সে কথাও আমরা অনেকেই বলি।
এখন আমরা কোনো বিশেষ মতলব হাসিলের বা সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কপট অনুসারী না হয়ে প্রকৃতই তাঁর উত্তরাধিকারের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই যদি, তাহলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সমগ্রতায় গ্রহণ করতে হবে—খণ্ডিতরূপে নয়। বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও কর্মের সমগ্রতাকেই ধারণ করেছে।
বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় বলে যা কথিত হচ্ছে, তা ইতিহাসের পশ্চাদ্গামিতার দ্যোতক নয়। ইতিহাস সর্বদা সামনের দিকেই চলে, তবে সরলরেখায় চলে না। ইতিহাসের গতি একান্তভাবেই দ্বান্দ্বিক, জটিল ও প্যাঁচালো।
সমাজ-ইতিহাসের নদীপ্রবাহটি চলতে চলতে কখনো কখনো এমন ধরনের বাঁক নেয় যে তখন মনে হয় সম্মুখবর্তী সমুদ্রের বদলে সেটি বুঝি পশ্চাতের উৎসমুখেই ফিরে যাবে। অথচ তেমনটি কখনো হয় না, হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের আপাতবিপর্যয় ঘটলেও, সমাজতন্ত্রের বদলে ইতিহাস যে ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করবে না, গত কয়েক বছরের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশেই সমাজতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়নি, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অভ্যন্তরেও শোষণবিরোধী সংগ্রামের দ্রুত বিস্তার ঘটে চলছে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক