১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার যে নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা, তার পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। তারপরও এই রক্তপাতের উৎস আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। যে ঘাতকেরা অভিযান পরিচালনা করেছিল বত্রিশ নম্বর সড়কের অরক্ষিত বাসভবনে, নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা যারা করেছিল ভাবলেশহীনভাবে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বর্বরতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকভাবে খতিয়ে দেখার রয়েছে। ঘটনাস্থলে সামনে ছিল যে ঘাতকদল, চারপাশে যারা ছিল তাদের সহযোগী, তাদেরও পেছনে ছিল ক্ষমতাধর আরও কিছু মানুষ, সেই সঙ্গে ছিল পরিস্থিতি বুঝে এগিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। বিশদ পরিকল্পনায় ইন্ধন জুগিয়েছেন কেউ কেউ, ইঙ্গিতে সায় দিয়েছেন আরও কেউ, যাঁদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। ১৫ আগস্টের হত্যাভিযান কোনো হঠাৎ নেওয়া হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল না, ঠান্ডা মাথায় নেওয়া হয়েছে এমন পরিকল্পনা, যেখানে সামনে যাদের দেখা যায় তার চেয়ে বেশি ব্যক্তি থাকে অদেখা। দেশের সীমা ছাড়িয়ে এই কুশীলবদের খোঁজ পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। সেখানে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সহজ নয়, তবে নানাভাবে এর হদিস বের করা সম্ভব। আজকের দিনে এই বাস্তবতা আবার আমাদের স্মরণ করতে হয় এবং সেই নিরীখে অনেক অসমাপ্ত কর্তব্য আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তবে এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শনাক্ত করা গুরুত্ববহ হলেও একই সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে স্বদেশ ও বিশ্বরাজনীতির প্রবণতা ও ধারা, বঙ্গবন্ধু-হত্যার যা ছিল পটভূমি, দক্ষতার সঙ্গে যা ব্যবহৃত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যা তো কেবল ক্ষমতার পালাবদল সূচিত করেনি, তা ছিল মতাদর্শ হত্যারও চেষ্টা। আর তাই হত্যাকারীরা তাদের খুনের মিশন সমাপ্ত করে হাজির হয়েছিল বেতারকেন্দ্রে। সেখানে দম্ভভরে হত্যার কথা ঘোষণার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ‘বাংলাদেশ বেতার’ নাম পাল্টে বেতারকেন্দ্রকে চিহ্নিত করল ‘রেডিও বাংলাদেশ’ হিসেবে, শ্রুতি-কল্যাণে যা ছিল ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর সমার্থক। হত্যার বার্তা পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের সরকারকে অভিনন্দন জানাল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে রাষ্ট্রের নাম স্বেচ্ছায় পাল্টে অভিহিত করলেন ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রূপে।
ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত মধ্য-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পূর্ণতর রূপ আমাদের খুঁজে ফিরতে হবে এবং এর জন্য বিভিন্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষ্য ও ইঙ্গিত যাচাই-বাছাই করার রয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড যে রাষ্ট্রপতি হত্যায় সীমিত ছিল না, প্রবল এক শ্রেণি-ঘৃণা এখানে কাজ করেছে, যে শ্রেণিকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির শক্ত আসনচ্যুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেটা তলিয়ে দেখার রয়েছে। যে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উগ্রতার অন্ধতা মোকাবিলা করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর বিপরীত শক্তি দিনে দিনে ঘৃণা ও বিদ্বেষের পাত্র ভরে তুলেছিল ষড়যন্ত্রমূলক নানা কাজ দ্বারা। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে আঘাত হানার এই কৌশলে উগ্র ডানপন্থী শক্তির সঙ্গে উগ্র বামের যোগসাজশ রাজনীতির অন্যতর এক সমীকরণ করে দিয়েছিল। সেই সঙ্গে উপমহাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান মরিয়া হয়েছিল হৃত পাকিস্তান না উদ্ধার পেলেও হৃত ক্ষমতা যেন আবার তারা ফিরে পায় পূর্বাংশে।
জেনারেল জিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ইমেজ এবং তাঁর সরকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অবস্থান নিয়ে যে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সেটা ব্যবহৃত হয়েঠিল বহু মানুষকে বহুভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য, যাকে বা যে গোষ্ঠীকে যেভাবে সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় প্রাণ দিতে হয়েছে বহু মুক্তিযোদ্ধাকে, বিশেষভাবে যাঁরা ছিলেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। অব্যাহত রক্তধারায় জিয়াউর রহমানের রক্তও যুক্ত হলো সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত উপজাত হয়ে। জিয়াউর রহমান হত্যা ও ক্ষমতার পালাবদল যে আদর্শিক ছিল না, সেটা জেনারেল এরশাদের কর্মকাণ্ড ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়; বরং একইভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ধর্মকে ঢাল করে সংবিধানের ওপর জেনারেল সাহেব চাপিয়ে দিলেন রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণা, সংবিধানের ও বাংলাদেশের মৌল আদর্শের সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক।
আমরা এখন উদযাপন করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বিষণ্ণ আগস্টে এই স্মরণকালে জোর তাগিদ উঠছে বঙ্গবন্ধু-হত্যার নেপথ্যের ঘটনা উদঘাটনের। বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার আইন জারির মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, খুনিরা পুরস্কৃত হয়েছিল বিভিন্নভাবে রাজনীতিতে তাদের অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা হলেও সেটা সফল হতে পারেনি। বস্তুত বিশাল প্রয়াস চলছিল বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার, তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলদেশের সব অঙ্গ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবহ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিসত্তার স্মারক ঝেড়ে-মুছে রাষ্ট্র ও সংবিধানকে ভিন্ন পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুসলিম বাংলা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি মোড়কে নানা আদর্শ ফেরি করা হয়েছে, যার ক্ষেত্রে যেটা কার্যকর হয়।
এমনি তথ্য-দলিলপত্র তো দেশের নানা দপ্তরে নানাভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। সেসব নিয়ে আমাদের কাজ হয়েছে খুব কম। সম্প্রতি এক অনন্য উদাহরণ তৈরি হয়েছে পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পুলিশের রেকর্ড পর্যালোচনা করে চৌদ্দ খণ্ডে তার প্রকাশনা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী ঘটনাধারা নিয়ে এমন কর্তব্য পালন আবশ্যকীয়, আমরা দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় না দিলে বাংলাদেশের উলট-পুরাণের পাঠ নিতে কখনোই সক্ষম হব না, সেই পাঠ ছাড়া সত্য-পুরাণের হদিসও আমরা পাব না। সেই কর্মের আহ্বান যেন আমরা শুনি, এমন প্রত্যাশা সবার।
লেখক: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর